শিরোনাম
◈ পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে কি আটক ? যা জানা গেলো (ভিডিও) ◈ এবার মোদির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় যা বললেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ ◈ ভুয়া ভিডিও শেয়ার করে দুঃখ প্রকাশ ভারতীয় সাংবাদিকের ◈ যুদ্ধবিরতির পর প্রথম সেনা বৈঠকে ভারত-পাকিস্তানের গুলি না চালানোর অঙ্গীকার, সীমান্ত থেকে সেনা কমানোর সিদ্ধান্ত ◈ যে কৌশলে ভারত-পাকিস্তান পরমাণু যুদ্ধ থামিয়েছেন, জানালেন ট্রাম্প ◈ হামজা চৌধুরীর দুর্দান্ত পারফর‌মেন্স, ফাইনালে শেফিল্ড ইউনাইটেড ◈ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বৈদ্যুতিক শাটল গাড়ি চালু ◈ ভারতের যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা কে এই আয়েশা ফারুক? ◈ গার্ডিয়ান থেকে বিবিসি; পশ্চিমা গণমাধ্যম কীভাবে ইসরাইলি অপরাধকে স্বাভাবিক হিসেবে প্রচার করে? ◈ রংপুর রাইডার্স এবা‌রো‌ গ্লোবাল সুপার লি‌গে অংশ নি‌চ্ছে

প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০৬:২৭ সকাল
আপডেট : ০৯ মে, ২০২৫, ০৪:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ও প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি: বদরুদ্দীন উমর 

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক-প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি। যেটা লেখা হয়েছে সেটা হলো সরকারি ভাষ্য, যা লেখা হয়েছে সেটা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মিথ্যা। বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

দেশের স্বাধীনতার ৫৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং পূর্বাপর ঘটনাবলি সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। ৯৩ বছর বয়সেও তিনি নিরলস চিন্তা, গবেষণা ও লেখায় সক্রিয় রয়েছেন। তার বলিষ্ঠ কণ্ঠ, ইতিহাস পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার দৃঢ়তা জাতীয় যে কোনো সংকটে আমাদের সাহস ও শক্তি যোগায়। 

স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং এ নিয়ে বিতর্ক ও প্রকৃত সত্য আড়াল করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর বাসসকে বলেন, এই স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রথম থেকে এমনভাবে বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবই এ যুদ্ধের মহানায়ক। পরে তো শেখ হাসিনা এই স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা এমনভাবে বলত যেন, এটা তাদের পারিবারিক ব্যাপার, তাদের পরিবারই নাকি এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, ইতিহাসের এই যে আবর্জনা এখন পরিষ্কারের সময় হয়েছে। 

স্বাধীনতা যুদ্ধ কিভাবে শুরু হলো- এ প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ১৯৭১ এর মার্চের শুরু থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের চলমান আলোচনা ভেঙে যাওয়ায় এবং ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হামলার কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছাড়া দেশের মানুষ একটি অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেখ মুজিব সম্পর্কে এটা বলা যায় যে, তিনি আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এটা একটা ভুয়া কথা। আসলে তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সর্বোচ্চ আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নিজে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। 

তিনি আসলে দুটো বিষয়কে মেনে নিতে পারেননি, একটা হচ্ছে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি, যেটা তিনি চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়া। এ জন্য স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইতেন না, তাজউদ্দিনসহ অন্য নেতারা দেশে কি হয়েছিল ৭১ সালে, সেটা জানানোর এবং বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তিনি কিছুতেই শুনতে চাইতেন না। 

শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি সম্পর্কে উমর বলেন, ৭ মার্চের যে বক্তৃতা, সাধারণত বলা হলো এটা ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা, কারণ শেখ মুজিব বলেছিলেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম ইত্যাদি, কিন্তু দেখা যায় এইসব কথা একেবারেই ভুয়া ছিল। এইসব কথা তিনি বলেছিলেন, তৎকালীন পরিস্থিতির চাপে। কেননা জনগণের অভ্যুত্থান তো ১ মার্চ থেকেই শুরু হয়েছিল। ইয়াহিয়া যখন বললো এখানে জাতীয় পরিষদের বৈঠক ৩ তারিখে হবে না, তখনই কারো অপেক্ষা না করে অভ্যুত্থান আরো তীব্র হলো। সেই পরিস্থিতির চাপে এবং স্বাধীনতার ঘোষণার জন্য তখন ছাত্রদেরও চাপ ছিল; এ চাপের মুখে উত্তেজনার বশে শেখ মুজিব এই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এতে তিনি এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, লাঠিসোঁটা নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো- এ জাতীয় কথাবার্তা বলেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য কেউ ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে না, ঘর থেকে বেরিয়েই যুদ্ধ করতে হয়। এটা লাঠিসোঁটারও কাজ নয়, যেখানে শত্রুরা কামান-বন্দুক-যুদ্ধবিমান নিয়ে সজ্জিত আছে; সেখানে লাঠিসোঁটায় কাজ হয় না- শেখ মুজিবের এসব ছিল কেবল কথার কথা। 

উমর বলেন, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন তাদের বলছেন, তোমরা আমার ভাই। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বলছেন, তোমরা আমার ভাই। এই ধরনের স্ববিরোধী কথাবার্তা ৭ মার্চের বক্তৃতায় ছিল। বলা হচ্ছে, এ ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা হলো এই বক্তৃতা দেয়া হলো ৭ তারিখে, এরপরে ১৫ তারিখে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলো এবং এরপর থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দলবল ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপ-আলোচনা করল। তখন এই আলোচনার সময় কি হয়েছিল, তারা কী বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি নিয়ে আলোচনা করেছিল, নাকি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করছিল। ক্ষমতার ভাগাভাগি ছিল পূর্ব-পাকিস্তান কতটা পাবে, পশ্চিম-পাকিস্তান কতটা পাবে। শেখ মুজিব যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা ছিলেন, এই ভাগাভাগির মধ্যে তার একটা লক্ষ্য ছিল প্রধানমন্ত্রী হওয়া। এটাই হচ্ছে সত্য, যারা বলে ৭ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে, তারা এ ব্যাপারে কী বলবে। ইয়াহিয়া এবং মুজিবের মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, স্বাধীনতার আলোচনা? এ  থেকে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ যতই হম্বিতম্বি করুক, যতোই স্বাধীনতার কথা বলুক- ওই সময় তাদের মাথায় স্বাধীনতার কোনো চিন্তা ছিলো না। শেখ মুজিব সব সময় আপস চাইছিলেন এবং এই আপস করে পৃথিবীর কোনো দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। এই আপোস করে তিনি পাকিস্তান সরকারের সাথে কোনো রকম একটা ক্ষমতা ভাগাভাগি চাইছিলেন। এর ফলে দেখা গেল ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী জনগণের ওপর আক্রমণ করল, তখন শেখ মুজিবসহ সব আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিল, একদিকে আওয়ামী লীগের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, অন্য দিকে একটা শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। আওয়ামী লীগের এই গান্ধীবাদী আন্দোলন ছিল একটা হাস্যকর ব্যাপার। 

যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতিই ছিল না? এমন প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দীন উমর বলেন, না আওয়ামী লীগের দিক থেকে যুদ্ধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তারা পুরোপুরি একটি সাংবিধানিক লাইনে এ সমস্যার সমাধান চাইছিল। তবে অন্যদিকে এ আশঙ্কাও ছিল যে একটা হামলা হতে পারে, ৭ মার্চের পর থেকে আওয়ামী লীগের লোকরা বেসামরিক প্রশাসন, রেডিও, টিভিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। কিন্তু আসল ক্ষমতা হলো সামরিক শক্তি, সেটা মোকাবিলা করার কোন প্রস্তুতি ছিল না। আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি ছিল একটা বায়বীয় ব্যাপার। 

এ অবস্থায় একদিকে পাকিস্তানি বাহিনী হামলার প্রস্তুতি নিতে থাকল। অন্যদিকে বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকরা চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ করল, তারা আওয়ামী লীগকে বিষয়টি জানাল,  কিন্তু আওয়ামী লীগ এসব পাত্তা দিল না। কারণ আওয়ামী লীগের লড়াই করার প্রস্তুতি এবং চিন্তাও ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার সাথে সাথে পুরো আওয়ামী লীগের কাঠামো ভেঙে পড়ল। শেখ মুজিব সকলকেই বলতে থাকলো পালাও-পালাও, সবাই পালানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মুখে শেখ মুজিবের যে নেতৃত্ব তা ভেঙে পড়ল। আন্দোলন যেভাবে করছিলেন সেটা সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়ল। কারণ সেটা মোকাবেলা করার কোনো প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের ছিল না। তাদের গেরিলা যুদ্ধেরও কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এ সময় আওয়ামী লীগ অসহায় অবস্থায় পড়ল। আওয়ামী লীগের নেতারা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বেশিরভাগ ইন্ডিয়ায় চলে গেল। 

সবাইকে পালিয়ে যেতে বলে শেখ মুজিবুর রহমান নিজে কেনো বাসায় থাকলেন, তার তো পালিয়ে গিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ শুরুর পরও তার বাসায় অবস্থানে পেছনে কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন- এ প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দীন উমর বলেন, শেখ মুজিব আত্মসমর্পণের জন্য বাড়িতে বসে রইলেন। আওয়ামী লীগের লোকেরা এবং তাদের বুদ্ধিজীবীরা বলে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে, তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। আমি বলেছি, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। আমি বারবার বিভিন্ন লেখায় এ কথা লেখায় আমার বিরুদ্ধে তারা ক্ষুব্ধ। সবাইকে শেখ মুজিব পালিয়ে যেতে বলছেন, আর তিনি বাড়িতে বসে থাকেন, তার মানেই হলো তিনি আত্মসমর্পণের জন্য অপেক্ষা করছেন এবং পাকিস্তানি বাহিনী এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল। এটা গ্রেপ্তার নয়, এটা আত্মসমর্পণ। তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো। 

পাকিস্তানের জেলে থেকে শেখ মুজিব কি জানতেন দেশে কি হচ্ছে? এর জবাবে উমর বলেন, সেখানে পুরো যুদ্ধের সময় নয় মাস জেলে ছিলেন, সেখানে তাকে কোনো খবরের কাগজ দেয়া হয়নি, রেডিও টেলিভিশনের কোনো খবর তিনি দেখতে পারেননি। তিনি যুদ্ধের কোনো খবরই জানতে পারেননি। কারও সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা বা নেতৃত্ব দেয়া তো দূরের কথা, তিনি জানতেনই না যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। তিনি পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর লন্ডনে গিয়ে জানলেন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু তার বেটি (শেখ হাসিনা) ঢাকডোল পিটিয়ে অনবরত বলছে, তিনি (শেখ মুজিব) ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। শেখ মুজিবের যে একটা ভাবমূর্তি এটাকে তারা ব্যবহার করছিল সেটাই তাদের সম্বল ছিল। এ পর্যন্তই, কিন্তু শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন এটা একটা সম্পূর্ণ ভুয়া কথা, মুক্তিযুদ্ধের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ করবে আর তাদের নেতা-কর্মীরা সব দেশের মাটি ছেড়ে পালালো,পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটা কোথাও নেই। তারা গিয়ে ভারত সরকারের হাতে দেশ স্বাধীন করার ভার ছেড়ে দিলো। এ জন্য ভারতীয়রা বলে থাকে এটা নাকি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, এক হিসেবে কথা ঠিক। ভারতের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ দিয়ে যে মুজিব বাহিনী তৈরি করেছিল তারা কেউ লড়াই করেনি। আওয়ামী লীগের কোন নেতা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি। তারা কলকাতায় ভালোই ছিল, আরাম-আয়েশে ছিল। 

এখানে লড়াই করেছে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। তারা যে লড়াই আরম্ভ করল আওয়ামী সেটা চায়নি। বাইরের কোন আক্রমণে নয়, দেশের ভেতরে থেকে সাধারণ মানুষ লড়াই করেছে, এ জন্যই পাকিস্তানি বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ অবদান এ দেশের জনগণের, তারাই লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী নেতা-কর্মীরা ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় এই লড়াইটা সম্পূর্ণ ভারত নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল। এ জন্য দেখা গেলো ১৬ ডিসেম্বর যখন আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর হলো, সেখানে ছিলেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরা। এই অরোরার কাছেই নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ও সর্বাধিনায়ক এম এজি ওসমানি সেখানে ছিলেন না। যৌথ কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বলা হলেও এখানে বাংলাদেশের কোন প্রতিনিধি রাখা হয়নি। গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তাকে কোনো চেয়ারও দেয়া হয়নি। এটা ছিল ভারতীর সামরিক বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ। 

স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিব দেশে ফিরে আসলেন। জনগণ তাকে ব্যাপকভাবে সমর্থন দিলেন। স্বাধীনতার আগের মুজিব আর স্বাধীনতার পরের মুজিরের শাসন, কী ঘটেছিল তখন? জবাবে বদরুদ্দীন উমর বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত সরকার এবং সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে। নিজের শক্তির জন্য এখানে বসেননি। কিন্তু দেশের মানুষ তাকে ভালোবেসেছিল। এই জনগণকে নিয়ে তিনি একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারতেন। সেটা না করে শুরু হলো লুটপাটের রাজত্ব। আওয়ামী লীগের লোকরা লুটপাট শুরু করলো। অবাঙালি লোকদের সব সম্পদ লুট হয়ে গেল। যারা আওয়ামী লীগের সাথে ছিল না তাদের ঘরবাড়ি লুট হলো, লুণ্ঠনজীবী শ্রেণি তৈরি হলো। শেখ মুজিব হলেন তাদের নেতা। কলকারখানা জাতীয়করণ করে আওয়ামী লীগের লোকদের হাতে তুলে দিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনি জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। দেশব্যাপী ভয়াবহ নির্যাতন শুরু হলো। জাসদ নেতা-কর্মীদের ওপর হত্যা-নির্যাতন শুরু হলো। 

রক্ষীবাহিনী গঠন প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিব রক্ষী বাহিনী গঠন করলেন। সেনাবাহিনীকে তিনি বিশ্বাস করতেন না, এই সেনাবাহিনীই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। এতে এমন হলো আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়ল। যে জনগণ শেখ মুজিবকে সমর্থন দিয়েছে তারা এ অবস্থা চায়নি, এ জন্য তারা দেশ স্বাধীন করেনি। এতে শেখ মুজিব ও তার দল জনসমর্থন হারিয়ে ফেলল। এমন জনবিচ্ছিন্ন অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের লেখা সংবিধান সংশোধন করে তিনি সব দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল চালু করলেন। দেশের সংবাদপত্র বন্ধ করে দিলেন। এমনকি সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকাও বন্ধ করা হলো। আমাদের মাসিক সংস্কৃতি পত্রিকাও বন্ধ করে দিলাম। দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হলো। ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করা হলো, ২ জানুয়ারি গভীর রাতে নিরাপত্তা হেফাজতে তাকে হত্যা করা হলো। এরপর শেখ মুজিব জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন, কোথায় সিরাজ সিকদার! প্রকৃতির প্রতিশোধ এমনই যে এর মাত্র কয়েকমাস পরে তিনি নিজেই নাই হয়ে গেলেন।

শেখ মুজিবের শাসনের পতন এবং ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ২০২৪ এর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে সাড়ে পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী শাসনের অবসান হয়েছে। ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের পর এই গণঅভ্যুত্থান একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৫২ সাল থেকে এখানে পরপর যে গণঅভ্যুত্থানগুলো ঘটেছে তার মধ্যে জুলাই মাসের এই গণঅভ্যুত্থান হলো সব থেকে ব্যাপক, গভীর এবং শাসকদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক।   

উমর বলেন, ৫ আগস্ট, ২০২৪ বাংলাদেশ রাহুমুক্ত হয়েছে। শেখ হাসিনা ও তার দলের সর্বস্তরের নেতা-মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিভিন্ন সাংগঠনিক কমিটির নেতা থেকে একেবারে নিচের স্তরের নেতারাও ঘরবাড়ি ছেড়ে পলায়ন করেছে। ২০০৯ সাল থেকে পনের বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে বাংলাদেশকে অক্টোপাসের মতো কামড়ে ধরে রেখেছিল, সে কামড় থেকে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্ত হয়ে জনগণ এখন যে স্বাধীনতা উপভোগ করছেন এতটা স্বাধীনতা- ১৯৭২ সালের পর আর কখনো ঘটেনি। 

অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ক্ষমতার ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেই শূন্যতা ঐতিহাসিকভাবেই পূরণ করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়