স্বপন ভট্টাচার্য্য: ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বৃহস্পতিবার, ১৩৫৯ সালের আটই ফাল্গুন বাংলা ভাষার ইতিহাসে এক অন্যতম কালো দিন। এই দিন পাক-সেনাদের পৈশাচিক আক্রমণে রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে শহিদ হন শুধু তাঁদের মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই করতে গিয়ে। তারপর থেকেই সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এই দিনটি শহিদ দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই দিনটি সরকারিভাবেও পালন করা হচ্ছে এবং এই দিনটি সেখানে সরকারি ছুটির দিন হিসেবেও ঘোষিত হয়েছে। বাংলাদেশের এই শহিদ দিবস কবে থেকে সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ (আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস নয়) হিসেবে পালিত হচ্ছে তা হয়তো আমাদের অনেকেরই জানা নেই। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের দুই ব্যক্তি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের কাছে আবেদন জানান। জাতিসংঘের ফেরদৌস নামের এক কর্মচারীর নজরে ওই আবেদনপত্রটি পৌঁছলে তিনি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালামকে কোনও সদস্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে ওই আবেদন রাষ্ট্রসংঘে পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেন।
ওই দুই ব্যক্তি এরপর ‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন এবং ওই সংস্থার মাধ্যমে ইউনেস্কোর কাছে একটি আবেদন পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ইউনেস্কোর আনা মারিয়া আবেদনকারীদের জানান যে অন্তত পাঁচটি সদস্য দেশ থেকে এই মর্মে প্রস্তাব জমা দিতে হবে। ওই সংগঠনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড ও বাংলাদেশ এই পাঁচ সদস্য দেশের পক্ষ থেকে আবেদন পাঠানো সম্ভব হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ওই প্রস্তাব ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে উত্থাপিত হলে ১৮৮ সদস্য দেশ সমর্থন করে। ২০০০ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি বছর এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এরপর ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ রাষ্ট্রসংঘের (ইউএনও) সাধারণ পরিষদের ৬৫তম সভায় একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সর্বসম্মতিক্রমে ওই প্রস্তাব গৃহীত হলে ২০১১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে প্রতি বছর এই দিনটি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে।
১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের অসম প্রদেশের শিলচরে অসম পুলিশ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য আন্দোলনরত নয়জন বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে ছিলেন কমলা ভট্টাচার্য নামের এক নারী। তিনিই ইতিহাসে প্রথম মহিলা যিনি মাতৃভাষার মর্যাদা রাখতে গিয়ে শহিদ হয়েছিলেন। এছাড়াও আরও কিছু মানুষকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পরে অন্য দুইজন বিক্ষোভকারী শহিদ হন। আমাদের অনেকেরই ধারণা যে ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যাঁরা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁরাই প্রথম ভাষা শহিদ। এই ধারণাটি কিন্তু ঠিক নয়। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির (বর্তমান তামিলনাড়ু) সমস্ত স্কুলে হিন্দি ভাষা বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে ১৯৩৭ সালে পেরিয়ারের নেতৃত্বে যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার গুলি চালালে দুই বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়েছিল।
প্রসঙ্গত ১৯৪০ সালে ওই বিতর্কিত আদেশ রদ করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন হয়েছিল এই বাংলার মানভূম জেলায়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও বাংলাভাষী মানভূম এবং ধলভূম জেলাকে নবগঠিত বিহার-উড়িষ্যা রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল এবং বাঙালিদের মুখ থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নেবার চেষ্টা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে সেখানকার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছেন। তাঁদের আশা ছিল যে ভারত স্বাধীন হলে হয়তো এই অন্যায় সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কংগ্রেস দল এবং বিহারের কংগ্রেস সরকার এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করে আরও কঠোরভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করল। মানভূম জেলা বরাবরই ছিল বাঙালি অধ্যুষিত তাই তারা এই সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে দলে দলে কংগ্রেস পার্টি ত্যাগ করে লোকসেবক সংঘের পতাকাতলে সমবেত হয়ে তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকল। ১৯৫৬ সালে মানভূম জেলাকে (পুরুলিয়া) পশ্চিমবঙ্গের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হলে ওই দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের সমাপ্তি হয়। ফেসবুকে ২১-২-২৪ প্রকাশিত হয়েছিলো।
আপনার মতামত লিখুন :