দীপক চৌধুরী : পদ্মা সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ ছিল না। দায়িত্বশীল অনেকে এটাও বলেছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ কয়েকবছর এ সেতু নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তোলা হয়েছিলো। এবং এখন, ২৫ জুন উদ্বোধনের দিনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্র চলছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ‘ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে’ সতর্ক থাকতে বলেছেন। সুতরাং পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে কীভাবে বিতর্কিত করা যায় এটা নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। আমরা দেখছি বন্যায় সুনামগঞ্জ-সিলেটের মানুষের কষ্ট কল্পনাতীত। কিন্তু আমরা বুঝি না, সুনামগঞ্জ-সিলেটের ভয়াবহ বন্যার সঙ্গে পদ্মা সেতুর অনুষ্ঠানের কী সম্পর্ক? ভুলে গেলে চলবে না আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকি। যারা পৃথিবীর এক-দুই-তিন-চার নাম্বার রাষ্ট্র সেসব দেশে বারবার মানবতা বিধ্বস্ত হয়, স্কুলে ঢুকে শিশু-কিশোর-যুব-যুবা শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে শতশত মানুষ প্রাণ হারায়। এটাই বাস্তবতা। মানবতার হৃদয় নিয়ে প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বচক্ষে বন্যা দেখে এসেছেন। এই বঙ্গবন্ধুকন্যা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে একগুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন।
১৯৯৮ সালের বন্যার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কার কী করা দরকার তাও বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী বলে এসেছেন। এবং প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে বন্যা কবলিত মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং স্যালাইন বিতরণ করাসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কারণ, তিনি মানুষকে ভালোবাসেন, ক্ষমতা নয় তিনি দেশকে ভালোবাসেন।
অনেকেই বাংলাদেশের প্রতিপক্ষের রাজনীতির পক্ষে ওকালতি করতে পছন্দ করেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলসহ অনেকে বলে থাকেন দেশে সুশাসন নেই, মানবাধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই। তাদের এসব কথিত অভিযোগের বিন্দুমাত্র সত্যতা মিলে না কোথাও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশে মিলিটারি ডিক্টেটরশিপ কে এনেছিল? জিয়া তো ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনীতি শুরু করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র ধ্বংসকারী মানুষ ছিলেন। ক্যু আর মানুষ হত্যা করা ছিল তার রাজনীতির মূল মন্ত্র। রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করা ছিল তার লক্ষ্য। বন্দুকের মুখে তা করেছেনও তিনি। হাঁ-না ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন পদ্ধতি ধ্বংস করার সূত্রপাত ঘটান তিনিই।
আমরা জানি, সেনানিবাস একটি সংরক্ষিত এলাকা। ২৭ বছর ধরে মইনুল রোডের বাড়িতে থেকে খালেদা জিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন। সেনানিবাসের ভেতরে অবস্থান করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা অনভিপ্রেত, বেআইনি এবং সেনানিবাসের শৃখলা, সেনা স্থাপনা ও নিরাপত্তার হুমকিস্বরূপ। অথচ বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া ২০১০ সাল উচ্ছেদের আগ পর্যন্ত এ বাড়িতেই ছিলেন। সেনানিবাসের বিধি ১৯২৪ অনুসারে সেনাবাহিনীর কোনো জায়গা কোনো ব্যক্তির অনুকূলে ইজারা দেওয়ার বিধান নেই। অবশ্য সেই খালেদা জিয়া এখন দুর্নীতির দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত।
আমরা আরেক জেনারেলের কথা যদি বলি তাও একইধারার ইতিহাস। এইচ এম এরশাদের রাজনীতির চিত্র যদি দেখি তাহলে বলতে হবে, জিয়ার পথ অনুসরণ করেই এরশাদ সামরিক শাসন এনেছিলেন। এরপর দল গঠন করেছেন। জনগণের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে এসব দলের তুলনা কি চলে, তুলনা করা উচিৎ? না, চলে না। কিন্তু নানারকম কায়দায় কৌশলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এসব দলের উপমা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন কেউ কেউ। এটাকে দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু বলার নেই।
এবার পদ্মা সেতু নিয়ে বলি। পদ্মা সেতু আমাদের আত্মমর্যাদার সেতু। বাঙালির গর্ব করার সেতু। সেই সেতু নিয়ে যখন একটি মহল নানারকম ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করলো তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৎ বলেই পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে তাদের তথাকথিত ‘দুর্নীতি’ প্রমাণ করতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সভা- সেমিনারে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিবিসি’র ‘হার্ডটক’-এ অংশ নিয়ে স্পষ্টভাষায় পরিষ্কারভাবে তাঁর সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন। অনেকেই জানেন, এ সেতু নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে। পরিকল্পিত চক্রান্তের উদ্দেশ্য ছিল বহুবিস্তারী। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে বিতর্কিত করা ও ব্যর্থতা দেখানোর পরিকল্পনা ছিল সেখানে প্রোথিত। যাতে যুক্ত হয় দেশের বিরোধী রাজনীতিক, সুশীল সমাজের কতিপয় ব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক একটি মহল। তাদের লক্ষ্য ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পকে কেন্দ্র করে করে একে দিয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত করা। মূল উদ্দেশ্য ছিলো বিশ^ব্যাপী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের জনপ্রিয়তার মুখে দুর্নীতির কলঙ্ক লাগানো।
সারা দুনিয়া জানে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সৎ রাজনীতিকদের একজন। তাঁর সাহসিকতা, সততা ও দূরদর্শিতার কাছে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অর্থনৈতিক সক্ষমতার উজ্জ্বলতম উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে যুক্তরা অবশ্যই ভাগ্যবান। দায়িত্ব পালনকারীরা ভাগ্যবান। পদ্মা সেতু নিয়ে দেশবিদেশে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু নিজেদের টাকায় এই সেতু নির্মাণ করে ষড়যন্ত্রকারীদের সমুচিত জবাব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক এবং অপমানের প্রতিশোধ। এই সেতু শুধু সেতু নয়, এটি প্রকৌশলজগতে এক বিস্ময়।
আসলে শক্তিশালী নদীর ওপরে পদ্মা–ই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সেতু, সুতরাং এদেশের জনগণ মনে করে, ইতিহাসের স্বার্থেই শেখ হাসিনার নাম মিশে রবে এ সেতুর সঙ্গে। পদ্মার মতো ধরনের পানিপ্রবাহ একমাত্র আমাজান নদীতে দেখা যায়। ওই নদীর ওপরে কোনো সেতু নেই। পদ্মা সেতুর পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার (ইআইএ) দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ। তাঁর মতে, এ ধরনের শক্তিশালী নদীর ওপরে পদ্মা–ই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সেতু।
ইলিশসহ জলজ প্রাণীর প্রজনন ও বিচরণ, সেতু নির্মাণকালে জমি অধিগ্রহণ, বাসিন্দাদের পুনর্বাসন, বৃক্ষরোপন সবকিছু মাথায় ছিল সংশ্লিষ্টদের। ১০০ বছরের কথা মাথায় রেখে পদ্মা সেতু করা হয়েছে বলেছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে দেশে এটিই প্রথম বড় প্রকল্প। আগামী ১০০ বছরে পদ্মা নদীর ওই অংশের বৃষ্টি, তাপমাত্রাসহ আবহাওয়ার অন্যান্য বিষয় আমরা হিসাব করেছি। তাতে দেখা গেছে, আগামী ১০০ বছরে সেখানে ২৬ শতাংশ বৃষ্টি বাড়বে। এতে সেখানে পানির প্রবাহ ১৬ শতাংশ বাড়বে। বাড়তি পানির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেতুর নকশা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পদ্মার পানির উচ্চতা দশমিক ৪ মিটার বাড়তে পারে। এ কারণে সেতুর উচ্চতা দশমিক ৪ মিটার বাড়ানো হয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হবে। ফিরোজ আহমেদের মতে, ‘পদ্মা সেতুর পরিবেশগত সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের ডলফিন, পাখি, উদ্ভিদের হিসাব আমরা করেছি। একটি বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ দল পাঁচ বছর ধরে তিন মাস পর পর পরিবেশ ও বন্য প্রাণীর ওপরে পর্যবেক্ষণ করছে। তাতে আমরা দেখেছি, সেতুর কারণে বন্য প্রাণীর কোনো ক্ষতি হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতেও হবে না।’
পদ্মা সেতু যাতে না হয় এর জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল ওরা আর এখন উদ্বোধনের আনন্দকে ম্লান করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ওই চক্রান্তকারীরা। এদের জনগণ চেনে। এর প্রধান হিসেবে নিজগুণে যিনি পরিচিতি পেয়েছেন তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। বিএনপি নেত্রী। এখন পদ্মা সেতু নিয়ে সারাদেশের মানুষ খুশি। এর উদ্বোধনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই খুশি হচ্ছে দেশের মানুষ। কিন্তু যারা মনেপ্রাণে এই সেতু চায়নি, পদ্মা সেতু হবে একথা বিশ্বাস করতে পারেনি ওরা এখন অস্থির হয়ে গেছে। আগে মানুষ, এরপর দেশ আর তারপর রাজনীতি- এটা ওদের নীতি থেকে উধাও। বাঙালর অগ্রগতির বিরুদ্ধে অবস্থানকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতায় উন্মাদ হয়ে গেছে। তাদের আচরণ ও কথাবার্তা দেখে মনে হচ্ছে আমরা একশ্রেণির উন্মাদের প্রলাপ শুনছি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের এক আলোচনায় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’
পদ্মা নিয়ে তৎকালীন সময়ে তুমুল সমালোচনা হলে সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, পদ্মা সেতু টিকবে না। এই সেতুটি হয়ে যাওয়ায় এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ দেখে মাথা খারাপ করা ‘কথাবার্তা’ শুনে আসছে মানুষ কিছু দিন ধরেই। বিএনপির অবস্থান তো সব সময় ছিল সমালোচনামুখর।
পাঠকদের মনে থাকার কথা, পদ্মা সেতু নিয়ে কথা বলা কমিয়ে দেয় বিএনপি তখনই যখন কানাডার আদালতের রায় পাওয়া গেল। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এই রায় হয়, যা জানা যায় এক মাস পর। সেই রায়ে বিচারক বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগকে গালগপ্প এবং উড়ো কথা বলে উড়িয়ে দেন। এর আগে? বিশ্বব্যাংক দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর বিএনপি সোচ্চার ছিল এবং লাফাচ্ছিল দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে।
অভিযোগ উঠেছে, এই অর্জনকে নস্যাৎ করতে দেশে বিদেশে তাদের দোসরদেরকে নিয়ে বিভিন্ন অপচেষ্টায় লিপ্ত। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতেই নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দুরন্ত সাহসের কারণেই বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পেরেছে।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক