আহসান হাবীব: আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের দুটি জিনিস বেশি একটি আবেগ অন্যটি অনুভূতি। এই অনুভূতির সম্পূর্ণটা হচ্ছে ধর্মানুভূতি। আবেগের আতিশয্য আমাদের সবসময় ঘিরে থাকে। সন্তানদের ঘিরে বাবামায়ের যে আবেগ, তা দেখলে মনে হবে তাদের সন্তানরা যেন এক একটা ফার্মের মুরগি। কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েদেরও হাতে তুলে খাওয়ে দেয়া মায়েদের খুব গর্বের বিষয়। স্কুল কলেজে পৌঁছে দেওয়া এবং আনা তাদের অন্যতম বিশাল কাজ। এবং এই ছেলেমেয়েরা যখন বিশ^বিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ে তখন তারা তাদের বাবামায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে তাদের জীবন তারা একদম শেষ করে দিয়েছে। তবে আয়রনি হচ্ছে এই সব সন্তানগণ যখন নিজেরা পিতামাতা হয়, তখন তাদের সন্তানদের প্রতি একই আচরণ করে। এ যেন এক প্রবাহ, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। শিক্ষা তাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
অভিভাবকতা কীÑ এই অঞ্চলের মানুষ তার কিছুই জানে না। যখন সন্তানরা বড় হয়ে তাদের দোষারোপ করে, তখন বাবামা তাদের জন্য কতো কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার ফিরিস্তি দিতে থাকে এবং কান্নাকাটি করতে থাকে। ফেসবুকে দেখবেন নিজেদের সন্তানদের নিয়ে কি আদিখ্যেতার ঢল। কী কারণ এই অতি আবেগের? কারণ একটাই এরা এখনো সামন্তীয় সম্পর্ক থেকে বের হতে পারেনি। এরা নিজেরা পণ্য আকারে প্রতিনিয়ত বিক্রি হয়ে চলেছে কিন্তু সম্পর্কের দিক থেকে পুরনোই থেকে গেছে, ফলে তারা যাদের কাছে নিজেদের শ্রম বিক্রি করছে, তাদের মালিক ভাবছে এবং সদা অবনত থাকছে। এখানে শ্রেণি অনুভূতি জাগছেই না। ফলে শোষণ কাজটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারছে মালিকগণ।
পরিবার এবং কাজের ক্ষেত্রে সম্পর্কের রূপটি একই থেকে যাচ্ছে আবেগ। একজন মালিক যখন তাকে কাজ দেয়, তখন সে ভাবে এটা মালিকের মহানুভবতা। একই বিষয় সে তার সন্তানদের প্রতিও করে। এখানে সে নিজেকে মহানুভব ভাবে এবং আবেগে ভাসতে থাকে। আর একটি জিনিস হচ্ছে অনুভূতি। এই অনুভূতির পুরোটাই এসেছে ধর্ম থেকে। এটাও সামন্তীয় অনুভূতিরই বৈশিষ্ট্য। দেবতা বা অবতারবাদ এই অনুভূতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। এরা দেবতাদের এমনি পূজা করে যে যদি তাদের সম্পর্কে কেউ সামান্য সমালোচনামূলক কিছু বলে, এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অনুভূতি এমনি স্থুল এবং পলকা যে সামান্য আঘাতেই ভেঙে পড়ে। কিন্তু ভেঙে পড়লে তো চলবে না, তাহলে দেবতা রুষ্ট হবে, তখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানে কোনো যুক্তিশীলতার বিন্দু বিসর্গ কাজ করে না। তাদের এই অনুভূতি যে সেকেলে হয়ে পড়েছে, এই বোধ তাদের ভেতর জাগ্রত হয় না। তারা সামন্তীয় এবং আদিম আবেগ দ্বারা চালিত হতেই থাকে। কিন্তু সমাজ তো একই জায়গায় আটকে নেই বা থাকে না, ফলে সম্পর্ক যে বদলে গেছে, এটা মানতে পারে না, তখন দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বে তারা বিশাল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং যেহেতু এদের সংখ্যা বেশি, আধিপত্য করতে থাকে। কি কারণ এই অতি অনুভূতির?
সামাজিক বিবর্তন বুঝতে না পারা এবং বিজ্ঞানহীনতা। সমাজের বিবর্তন বুঝতে হলে এর বিজ্ঞানটা জানতে এবং বুঝতে হয়। কিন্তু ধর্ম যেহেতু স্থির এবং অনড় একটি বিষয়, সূতরাং তাদের মনোজগৎ আদিম ছকে বাঁধা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনীতি বিজ্ঞানকেন্দ্রিক নয়, ধর্মকেন্দ্রিক। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন হলেও এর উপরিকাঠামো- সংস্কৃতিতে তার প্রভাব এবং প্রকাশ তদনুরূপ নয় বরং এখানে যখন এমনকি এগিয়ে থাকা মানুষগুলো রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করে, সেখানেও থাকে আবেগের আধিক্য। শোষিত মানুষের জন্য এরা দরদ দেখায় কিন্তু বিজ্ঞান সম্মত একটি পার্টি গড়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে না এবং ধর্মানুভূতির বিরুদ্ধে এরা টুঁ শব্দটিও করে না। ফলে এখানে আবেগ এবং অনুভূতির প্রাবল্যে সবকিছু ভেসে চলে খড়কুটোর মত। বিজ্ঞান- সামাজিক এবং প্রাকৃতিক- শিক্ষা এবং তা ধারণ করা ছাড়া আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র নির্মাণ শুধু স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে এবং রাজনীতি, সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক আবহেই ঘুরপাক খেতে থাকবে।
লেখক: ঔপন্যাসিক