শিরোনাম
◈ এবার আনন্দবাজারে ওবায়দুল কাদেরের সাক্ষাৎকার, জানালেন নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা (ভিডিও) ◈ নির্বাচনের মাঠে ঘুরে দাঁড়ানো পুলিশ: প্রস্তুতি, চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা ◈ "পাষন্ড স্বামীর কান্ড" ঈদের দিন স্ত্রী কে জবাই করে হত্যা ◈ দ্রুতগতিতে টার্ন নিতে গিয়ে যাত্রীবাহী কোচ খাদে পড়ে ৫৫ যাত্রী আহত ◈ সৌদি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানা গেলো ২০২৬ সালে কবে রমজান ও ঈদ ◈ ‌ক্রিকেটার‌দের পাওনা টাকা না দিয়ে দেশ ছাড়া ক‌রে‌ছে ওমান ক্রিকেট বোর্ড ◈ ভারতে দাঙ্গা লাগাতে চেয়েছিল পাকিস্তান'- জম্মু-কাশ্মীর সফরে গিয়ে বলেছেন নরেন্দ্র মোদী ◈ ‌টি‌কি‌টের দা‌বি‌তে বাফুফে ভবনের সামনেই ফুটবল আলট্রাসের ঈদ ◈ নেত্রীর সঙ্গে দেখা আমাদের প্রেরণা দেয়’—ঈদ রাতে ফিরোজায় বিএনপি নেতারা ◈ প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন সম্ভব? কী বলছে নির্বাচন কমিশন ও বিশেষজ্ঞরা

প্রকাশিত : ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪, ০৪:১৮ সকাল
আপডেট : ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪, ০৪:১৮ সকাল

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তর স্বভাষায় প্রত্যাবর্তন

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: রাজনারায়ণ দত্তর পুত্র মধুসূদন দত্ত ১৮৪৩-এ উনিশ বছর বয়সে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁকে দীক্ষা দান করেন যাজক ডিলট্রি। তিনিই ‘মাইকেল’ নামকরণ করেন। ব্যাপারটি ঘটে ১৮৪৩-এর ৯ ফেব্রুয়ারি। মধুসূদন-এর স্বজাতি ও স্বসংস্কৃতি ত্যাগ করার প্রাথমিক উদ্যোগ ঘটনাটি। বাবা সন্তানকে ধর্মান্তরের কারণে ত্যাজ্যপুত্র করেন। বোঝাই যায়, এই ধর্মান্তরণ সামাজিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।

কাকের ময়ূরপুচ্ছ লাগানোর কথা বাংলা প্রবচনে আছে। কিন্তু আমরা জানি, ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে কাক কখনও ময়ূর হয় না। কারণ ময়ূরের কণ্ঠে যে মধু আছে, তা কাকের হয় না। কিন্তু অনেক মানুষ কাক হয়েও ময়ূর হতে চেয়েছিলেন বা হবার চেষ্টা করেন; এমন প্রয়াসে প্রাণপাতও করেছিলেন বা করেন। মধুসূদন-এর যে এমন আকাক্সক্ষা ছিল তার প্রমাণ তাঁর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। তিনি বাঙালি হয়েও ইংরেজি সাহিত্য রচনা করে খ্যাতিমান ইংরেজের সঙ্গে পাল্লা দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বোধোদয় হবার পর তিনি ফিরেছিলেন স্বভাষা ও স্বসংস্কৃতিতে। এখানেই তাঁর ব্যতিক্রম এবং এ কারণেই তিনি কীর্তিত। তাঁর ৪৯ বছর জীবনে মহিমাময় কীর্তি তাঁর রচনাসমূহ; কিন্তু বড় কীর্তি এ প্রত্যাবর্তন। অবশ্য ইংরেজি সাহিত্য-সংস্কৃতি ময়ূরের সঙ্গে, আর ভারতীয় যা কিছু তা, কাকের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। ইংরেজ উপনিবেশবাদ পরের ধন লুট করে স্ফীত হয়েছে, যা কখনও উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতি হতে পারে না। কিন্তু আমরা মানি আর না মানি, মধুসূদন তো এক পর্যায়ে তা মেনেছিলেন। ইংরেজরা উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক-বাহক, এমনকি তিনি বিয়ে করেছিলেন দুজন অবাঙালি মহিলাকেÑ ইংরেজ ও ফরাসি। ইংরেজ রেবেকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে টেকেনি; কিন্তু ফরাসি হেনরিয়েটা মধুসূদনের সঙ্গে আমৃত্যু দাম্পত্য করেছেন। তিনি তো বিলাত ও ফ্রান্সে প্রবাস জীবন কাটিয়েছিলেন। এসবই তো ছিল তাঁর উন্মুল বাসনার দ্যোতক।
মধুসূদন-এর বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিতে ফিরে আসার বড় প্রমাণ তাঁর ১৮৬০-এর কবিতা ‘বঙ্গভাষা’,
হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মন;
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;-
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে-
‘ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি অজ্ঞান তুই যা রে ফিরি ঘরে।’
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
কবিতাটি নিয়ে কিছু কথা আছে, মধুসূদন -এর চতুর্দশপদী কবিতাবলী গ্রন্থ থেকে কবিতাটি সংগৃহীত হয়েছে, যা প্রকাশিত হয় ১৮৬৬-তে। কিন্তু কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৮৬০-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। অবশ্য ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে থাকার সময় ১৮৬৫-তে মধুসূদন রীতিমতো চতুর্দশপদী সনেট রচনায় ব্রতী হন। এক্ষেত্রে তিনি সনেটের জনক ইতালীয় কবি পের্ত্রাক (১৩০৪-১৩৭৬)-এর অনুসরণ করেন। 
কবির সংক্ষিপ্ত পরিচয়, তিনি বাঙালি কবি ও নাট্যকার। তবে তাঁর বিস্তৃত পরিচয় এভাবে হতে পারে, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী লেখক, প্রথম আধুনিক কবি, প্রথম আধুনিক নাট্যকার, অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, বাংলা সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার প্রথম রচয়িতা; সার্থক ট্র্যাজেডির প্রথম রচয়িতা; প্রথম প্রহসন রচয়িতা; পুরাণকাহিনির ব্যত্যয় ঘটিয়ে আধুনিক সাহিত্যরস সৃষ্টির প্রথম শিল্পী; পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যধারার সংমিশ্রণে নতুন ধারার মহাকাব্য রচয়িতা।’ (ড. সৌমিত্র শেখর, সাহিত্য-জিজ্ঞাসা ঢাকা: অগ্নি পাবলিকেশন্স, ২০০৭; পৃ. ১৩৯)। অর্থাৎ তিনি অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম, এবং তা বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে।
আমার উপলব্ধ সত্য ও ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা হলো, নারীর কাছে যার হাতে খড়ি, সে পুরুষ বাস্তব জীবনে একজন কৃতবিদ্য মানুষ হয়ে উঠেন। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে এন্তার আছে। মধুসূদন-এর ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন মা জাহ্নবী দেবী, যাঁর কাছে তিনি রপ্ত করেছিলেন রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ-প্রভৃতি। সাগরদাঁড়ি গ্রামের পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ঈমাম লুৎফুল হক তাঁকে শিখিয়েছিলেন বাংলা, আরবি ও ফারসি। তথ্য আছে, ঈমাম নিজেও বিদ্বান ছিলেন। বলা যায়, মা আর ঈমাম মিলে মধুসূদন-এর কৃতবিদ্য হবার পথ সুগম করেছিলেন। তেরো বছর বয়সে তিনি কলকাতার বাসিন্দা হন। হিন্দু কলেজের ছাত্র হিসেবে মেধাবী তরুণ মধুসূদন অধ্যক্ষ রিচার্ডসন-এর নজর কাড়েন। উল্লেখ্য, এ অধ্যক্ষই তার  মনে কাব্যপ্রীতি স ার করেছিলেন। এ কলেজে তাঁর সতীর্থ ছিলেন উনিশ শতকের নামকরা বেশ কিছু ব্যক্তি; যাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক, এবং প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ। কিন্তু এ কলেজে পড়তে পড়তেই মধুসূদন-এর মনে বিলাত-প্রবাসী হবার আকাক্সক্ষা বদ্ধমূল হয়। 
মধুসূদন বারোটি ভাষা জানতেন। তিনি যে, শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে ভাষাগত দক্ষতা  অর্জনকরেছেন, তার বর্ণনা বিদগ্ধ গবেষক গোলাম মুরশিদ তাঁর আশার ছলনে ভুলি গ্রন্থে তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘সকালে দু’ঘণ্টা পড়েন হিব্রু, দুপুরের পর দু’ঘণ্টা গ্রিক, বিকেলে তিন ঘণ্টা তেলেগু ও সংস্কৃত, সন্ধ্যে বেলায় দু’ঘণ্টা  ল্যাটিন, আর রাতের বেলা তিন ঘণ্টা ইংরেজি-মোট বারো ঘণ্টা।’ (পৃ. ১২১, উদ্ধৃত ড. সৌমিত্র শেখর, পৃ. ১৩৭)। মধুসূদন ভালো ইংরেজি জানতেন ও লিখতেন।তাঁর রচনায় অনেক সমৃদ্ধ ইংরেজি কর্ম আছে। ইংরেজি কাব্যের মধ্যে আছে কালেক্টেড পোয়েম্স, দ্য অপ্সরি: এ স্টোরি ফ্রম হিন্দু মিথোলজি, দ্য ক্যাপটিভ লেডী এবং ভিশন্স অফ দ্য পাস্ট। প্রবন্ধ সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখ্য ‘দ্য এ্যাংলো-ম্যাক্সন অ্যান্ড দ্য হিন্দু’, ‘অন পোয়েট্টি এটসেট্টা’, এবং ‘অ্যান এসে।’ এছাড়াও বেশ কিছু অগ্রন্থিত ইংরেজি রচনা আছে।
মধুসূদন তাঁর এক কপি দ্য ক্যাপটিভ লেডী বন্ধু গৌরদাস বসাকড়কে সৌজন্য উপহার পাঠান; বন্ধুপ্রীতির নিদর্শন হিসেবে তিনি বইটি আবার জে.ই.ডি. বেথুন-এর কাছে উপহার হিসেবে পাঠান। বেথুন বইটি পড়ে মুগ্ধ হন ঠিকই; কিন্তু বাস্তববাদী পরামর্শ দিয়ে মধুসূদনকে দেশ ফিরে এসে বাংলায় কাব্যরচনা করতে বলেন। মধুসূদন এ পরামর্শ মেনে ১৮৫৬-তে দেশে ফেরেন এবং বাংলা ভাষায় কাব্যরচনায় ব্রতী হন। 
উল্লেখ্য ‘বঙ্গভাষা’ কবিতায় মধুসূদন একাধিকবার তাঁর উন্মুল বাসনার ভ্রম স্বীকার করেছেন। নিজেকে তিনি ‘অবোধ’ বলেছেন এবং ফিরে এসেছেন’ মাতৃভাষা-রূপ খনি, পূর্ণ মণিজালে।’ উপরন্তু নিজেকে উপদেশ দিয়েছেন, ‘পর-ধন-লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ’ এবং ‘পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’ সুতরাং মধুসূদন-এর স্বদেশ ও স্বভাষায় প্রত্যাবর্তনের পটভূমি এভাবেই অনুসন্ধান করতে হয়। ১৮৭৩-এর ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে কপর্দকহীন মধুসূদন-এর লোকান্তরণ ঘটে। জন্মভূমি স্বদেশের প্রতি তাঁর সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন আছে তাঁর সমাধিস্থলে উৎকীর্ণ পঙক্তিমালায়Ñ
‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে। তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম)
মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন।
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’
উল্লেখ্য সমাধিফলকে কবি মধুসূদন তাঁর স্বদেশ ও স্বকুল প্রেমের কথা বলেছেন। মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তর (১৮২৪-১৮৭৩) স্বভাষায় প্রত্যাবর্তন। ২০ জানুয়ারি ২০২৪ মধুমেলায় প্রধান অতিথির ভাষণ। লেখক: চেয়ার প্রফেসর,  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার; বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)। 

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়