শিরোনাম
◈ ভালোবাসার শহর প্যারিসে বৃষ্টিভেজা রাতে শুরু হলো অলিম্পিকস ২০২৪ ◈ সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী আজ ◈ কারফিউ আরো শিথিলের সিদ্ধান্ত হবে আজ, জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ একদফা দাবিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক বিএনপির ◈ শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে শ্রীলঙ্কা  ◈ ডিবি হেফাজতে কোটা আন্দোলনের ৩ সমন্বয়ক ◈ কোটা আন্দোলন: ঢামেকে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীসহ তিন জনের মৃত্যু ◈ হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষ হত্যার জবাব জনগণ একদিন আদায় করে নেবে: মির্জা ফখরুল ◈ প্রতিটি হামলার ঘটনার বিচার হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ◈ সাম্প্রতিক সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার: প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১২:২২ রাত
আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১২:২২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর জলাভূমি ও জলচর পাখি

বিশ্ব রঞ্জন গোস্বামী: টাঙ্গুয়ার হাওর আকারে ৯৫০০ হেক্টর, যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মিষ্টি জলের জলাভূমি। এখানে প্রচুর পরিযায়ী ও আবাসিক জলচারী পাখি বিচরন করে। এর অনন্য পরিবেশগত, অর্থনৈতিক কারণে উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের প্লাবনভূমি এবং এই অঞ্চলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জলাভূমি। একে রামসার পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে অনেক জলাভূমি নিঃচিহ্ন হতে বসেছে। অথচ তার সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বব্যাপী গুরুত্বর্পূণ বিপজ্জনক তালিকার অনেক জলচর পাখির এখানে বাস করা যেমন ভূতি হাঁস, লালমুড়ি বা রাঙ্গামুড়ি, শিখাযুক্ত বা ফুলুরি হাঁস, ছোট ভূতি হাঁস, গয়ার এবং জৌরলি ইত্যাদি।  

টাঙ্গুয়ার হাওর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলায় (২৫ক্ক০৮′৪৯.১″ ঘ ৯১ক্ক০৪′৪৪.৯″ ঊ) ও চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে বিশ্বের সর্বচ্চো বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ক্যাচমেন্ট এলাকায় অবস্থিত। এই জলাভূমির উপর অনেক পরিযায়ীসহ স্থানীয় বিভিন্ন জলের পাখির আবাস। তাছাড়া মৎস্যসম্পদের জন্য বহু স্থানীয় লোকেদের জীবিকা এই জলাভূমির সাথে জড়িত। তাই এর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নিঃসন্দেহে জরুরি। বিভিন্ন কারণে টাঙ্গুয়ার হাওর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের ভূসংস্থান এবং প্রধান নদীগুলো যেমন যমুনা, ব্রম্মপুত্র ও মেঘনা নদী ব্যবস্থার মধ্যে এর অবস্থানের ফলে নদীগুলোর স্রোত প্রচুর পরিমাণে জলাভূমিকে সমবৃদ্ধ করে। যেমন হাওর (অগভীর বা ঋতু অনুসারে প্লাবিত মিঠা জলের জলাভূমি), বাওর (মিঠা জলের হ্রদ), বিল ( নীচু প্রায়ই যা হাওর অববাহিকায় অবস্থিত)। দেখা গেছে বিভিন্ন জলাশয় বা হ্রদ যা বিভিন্ন মরসুমে ৩০ সে.মি বা তার বেশি গভীরতায় প্লাবিত হয়। বিভিন্ন নদী আন্তর্জাতিক ভাবে উল্লেখযোগ্য আন্তঃসীমান্ত নদী ও বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ব-দ্বীপ সহ বাংলাদেশকে তার বর্তমান আকারে রূপ দিয়েছে। 

‘বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশানাল’ (২০২১) সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরকে ১৯৯৯ সালে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ঊঈঅ),২০০০ সালে একটি রামসারএলাকা , ২০০৭ সালে একটি গুরুত্বপূর্ন পাখি ও জীববৈচিত্র্য এলাকা হিসাবে ঘোষনা করা হয়। এখানকার পরিবেশগত, জৈবিক ও অর্থনৈতিক কারণে  টাঙ্গুয়ার হাওরে সর্বমোট ২০৬ রকম প্রজাতির পাখির আবাসস্থল, যার মধ্যে রয়েছে সংকটাপন্ন ভূতি হাঁস, দুর্বল লালমুড়ি বা রাঙ্গামুড়ি, বিপন্ন কোরোল, হুমকিপূর্ন প্রজাতি বড় চিত্রিত ঈগল ইত্যাদি।প্রতি শীতে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রচুর সংখ্যক জলচারী পাখির সমাগম হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৬০, ০০০ থেকে ১,০০,০০০ সংখ্যক পাখি দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০০৪ সালে সর্বাধিক ২,৮০,০০০ জলচর পাখির সমাগম হয়েছিল বলে একটি রিপোর্টে প্রকাশ। পাখি বৈচিত্রের পাশাপাশি এখানে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৭টি সরীসৃপ, ১১টি উভচর প্রাণী, ১৪১টি স্বাদুজলের মাছ,১০৯টি মিষ্টি জলের মাছ রয়েছে, তাছাড়া ২০০টির উপরে উদ্ভিদ প্রজাতিও আছে এখানে। টাঙ্গুয়ার হাওরের উপর আনুমানিক ৭০,০০০ স্থানীয় লোকের জীবিকা নির্ভর করে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকজন বিজ্ঞানী ও গবেষক যেমন এ. বি. এম.সারোয়ার আলমসহ আরও ৬ জন বিজ্ঞানী উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের টাঙ্গুয়ার হাওর জলাভূমিতে জলচর পাখির সংখ্যার প্রবণতা এবং স্থানীয় পরিবেশগত কারণের প্রভাব এই নিয়ে একটি গবেষণা পত্র ‘এভিয়ান কনজারভেশন অ্যান্ড ইকোলজি’ নামক গবেষণা পত্রিকায় গত ২০২৩ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে টাঙ্গুয়ার হাওর জলাভূমির উপর অনেক গবেষণামূলক তথ্য আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে।

বর্ষাকালে (মে-সেপ্টেম্বর ) সমগ্র এলাকা জলমগ্ন থাকে যার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৫০০০ মিমি বা তার চেয়ে বেশি হয়। আবার শুখা মরসুমে (অক্টেবর-এপ্রিল) জলের স্তর ব্যাপকভাবে কমে গিয়ে ৬.১০ মিটার থেকে ২.৬০ মিটারে গিয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে অসংখ্য অগভীর জলাশয় শুকিয়ে যায়। সেই সাথে নল খাগড়া সহ অন্যান জলাভূমির ঘাষ ও অনেক জলজ উদ্ভিদও হ্রাস পায়। টাঙ্গুয়ার হাওর মূলত ছয়টি বিল যেমন বরোবেরিয়া, ছোটেন্না, হাতিরগাথা, লেচুরমারা, রোয়া এবং  রূপবই নিয়ে গঠিত। এইসব বিলেই তাঁরা সমীক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা করেন। প্রথমিকভাবে পাখি শুমারীর কাজটি এই ছয়টি বিলে পরিচালিত হয়েছিল। কেননা বেশির ভাগ পাখি এখানেই থাকে। গবেষকদের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের অন্যান জলাভূমির তুলনায় টাঙ্গুয়ার হাওরে জলচর পাখির সংখ্যা বেশি। ২০১০-২০১৩ এবং ২০১৫ সালে বাংলাদেশে গণনা করা সমস্ত জলচর পাখির ৫০% এরও বেশি টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখা গিয়েছিল। পরিযায়ী জলচর পাখির সংখ্যার প্রবণতা ও পরিবেশগত কারণগুলো যা তাদের প্রাচুর্যকে প্রভাবিত করে তা চিহ্নিত করতে ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে  জলচর পাখির শুমারি পরিচালনা করা হয়। তাঁরা মোট ৬৯টি প্রজাতির জলচর পাখি রেকর্ড করেন ও তার মধ্যে ৪৭টি প্রজাতির সংখ্যার প্রবনতা মূল্যায়ন করেন।

প্রতিবেশী দেশগুলোর নিকটবর্তী স্থানগুলোর পাখি গণনার তুলনা করলে এটা স্পষ্ট যে টাঙ্গুয়ার হাওর হলো এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান মিঠাজলের বৈচিত্রপূর্ণ জলাভূমি। ওয়েটল্যান্ডস ইন্টারন্যাশনাল সাউথ এশিয়া, ২০২০ এর এক সূত্র অনুসারে জানা যায় ২০১৫ সালে অংরধহ ডবঃষধহফ ঈবহংঁং (অডঈ) দ্বারা পরিচালিত পাখিশুমারী অনুযায়ী ভারতের আসাম রাজ্যে ৩২৮৪১টি, পশ্চিমবঙ্গে ২৭৪৪৪টি ও মনিপুরে ৫০৭২৫টি জলচর পাখি গণনা করা হয়েছিল। মিয়ানমায়েরের প্রতিবেশী উপকূলে ৪০টি প্রজাতি বা ১৫০০০ সংখ্যকের চেয়ে বেশি জলচর পাখি পাওয়া গেছে। একইভাবে থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় মিঠা জলের জলাভূমি বুং বোরোফেটে ১২ বছরের গবেষণায় ৩৫টি আবাসিক প্রজাতির পাখি পাওয় গেছে, যা গড়সংখ্যার নিরিখে মোট ২৫৩০০টি। আবার টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০০৮ থেকে ২০২১ সালে গড় পাখির সংখ্যা ২৯৩৬৬টি, তার মধ্যে শুধু ২০১৩ সালেই এর সর্Ÿোচ্চ সংখ্যাটি ছিল ১৬৬৭৮৮টি ।

জলাভূমির সংকটের ঈঙ্গিত: একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষের কার্যকলাপের ফলে মূল হাওর অববাহিকার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। একটি পরিসংখ্যান দেখলেই তা বোঝা যায়। মাত্র তিন দশকে ৪০% নীচু জমি কৃষি জমি ও মানুষের বসতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সমীক্ষা আরও ঈঙ্গিত করে যে ১৯৮০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত গভীর জলের এলাকা প্রায় ৭১ শতাংশ অগভীর জল এলাকায় পরিণত হয়েছে, তারপর তা ধানচাষের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। গাহর্স্থ হাঁস পালন, গবাদি পশু চারণ, মোটর চালিত হাতে চালানো নৌকা এবং জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য ওই এলাকার বাস্তুত্রন্তের ব্যাঘাত ঘটায় যা কিনা টাঙ্গুয়ার হাওরে পরিযায়ী জলচর পাখির জন্য বিশেষ সংকট নিয়ে এসেছে। এছাড়াও জাল ও বিষাক্ত টোপ ব্যবহার করে অবৈধ জলচর পাখি শিকার বিশেষত শীতকালে টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকাসহ উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের জলাভূমিতে সমস্যা বাড়ছে।

টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ এর গোড়ার দিকে শুরু করেন ও ২০০০ সালে পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ওটঈঘ বাংলাদেশ সংস্থার মাধ্যমে একটিসহ ব্যবস্থাপনা উদ্যোগের তিনটি ধাপ ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালে বাস্তবায়ন করে। প্রাকৃতিক সম্পদের সুসংহত ব্যবহারের জন্য টাঙ্গুয়ার হাওর প্রকল্পের অধীন কিছু ব্যবস্থা প্রবর্তন করে, তাহলো প্রথাগত ইজারা ব্যবস্থা বাতিল করে একটি পারমিট ভিত্তিক মাছ ধরাার প্রকল্প প্রতিষ্টা করা হয়। তার ফলে জেলেদের অধিকার নিশ্চত করে তা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের সুসংহত ব্যবহার করা সম্ভব। গবেষক দলটি সুপারিশ করে যে ২০১০ সালের টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাটি আরও শক্তিশালী ও সংশোধিত করে টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার কাঠামো এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা জারি করা উচিত।তর ফলে গবাদি পশুপালন এবং গৃহপালিত হাঁসের চারণ, বন উজাড়,অবৈধ সম্পদ আহরন এবং জলস্তর ব্যবস্থাপনার মতো বিপদগুলো মোকাবেলা করা যেতে পারে। তথ্যসূত্র : এভিয়ান কনজারভেশন আ্যন্ড ইকোলজি নামক গবেষনা পত্রিকার ভলিউম নম্বর-১৮, সংখ্যা-১,২০২৩। লেখক পরিচিতি : বিজ্ঞান লেখক। সদ্যস, জীব বৈচিত্র কারণে একাডেমি ,কলকাতা। goswamibiswaranjan@gmail.com

                                                                                                                    

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়