প্রভাষ আমিন: একাত্তর সালে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর বাইরে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে একটি বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক। তারুণ্যদীপ্ত এই বাহিনী বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারও নেতৃত্ব মানতে চাইতো না। এ নিয়ে তখন কিছু ভুল বোঝাবুঝিও ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না।
একাত্তর সালে কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন একবছরের মধ্যেই সিরাজুল আলম খানের হাতে গড়া জাসদ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পথে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ৭২ থেকে ৭৫ এই তিন বছরে জাসদ হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ধ্বংসের রাজনীতির সূচনা করেছিল জাসদ। থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, ঈদের জামাতে এমপি খুন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় হামলা, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার মতো অপরাজনীতি করেছিল জাসদ। এমনকি ৭৫’র ১৫ আগস্টের পর জাসদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আসলে জাসদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী বিরোধিতার জন্য।
৭২-৭৫ সময়ে জাসদের রাজনীতি যারা দেখেছেন, তারা কি কখনও ভাবতে পেরেছিলেন, জাসদ একদিন আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সঙ্গী হবেন। জাসদের আ স ম আব্দুর রব বা হাসানুল হক ইনু শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী হবেন। যেমন, আ স ম আব্দুর রবের কথাই ভাবুন। একসময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, তারপর জাসদের নেতা হয়েছেন। এখনও তিনি জাসদের একটি অংশের নেতা। কিন্তু একজন নেতা তার জীবনে কতবার রূপ বদলাতে পারেন? একসময় বঙ্গবন্ধুর শিষ্য ছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর কট্টর সমালোচক ছিলেন। জিয়ার অনুগ্রহে জার্মানিতে উন্নত চিকিৎসা পেয়েছেন। এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে আসা আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন। এখন আবার তিনি শেখ হাসিনার কট্টর সমালোচক। মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ করেছেন, বাসদ করেছেন, আওয়ামী লীগ করেছেন। এখন পারলে শেখ হাসিনাকে টেনে নামান।
অত পেছনে গেলে অনেকে হয়তো রিলেট করতে পারবেন না। আরেকটু কাছে আসি। ৯০’র ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের সময় কেউ কি ভাবতে পেরেছিলেন, পতিত এরশাদ আবার রাজনীতিতে ফিরবেন। পতিত হওয়ার ১০ বছরের মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধবেন। এরশাদ আবার শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে এক টেবিলে বসে আলোচনা করবেন, রাজনীতি করবেন। জাতীয় পার্টির তখনকার বাঘা বাঘা নেতা-মন্ত্রী, ৬ ডিসেম্বর যারা বোরখা পরে পালিয়েছিল; তারাও যে আবার মন্ত্রী-এমপি হবে সেটা আমি কখনও কল্পনা করিনি। এখন দেখি আমি বোকার হদ্দ। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই নেতারা বলেন, অত কিছু বুঝবেন না। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
রাজনীতিতে শেষ কথা নেই, এই কথা বলে কতো কিছু যে জায়েজ করা যায়। বামদের সাথে মিলে ১৪ দলীয় জোট আর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট করে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ বরাবরই বাংলাদেশের প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু সেই আওয়ামী লীগ যখন হেফাজতে ইসলামের মতো দেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আপস করে, অনেকে অবাক হন। আমি অবশ্য অবাক হই না। রাজনীতিতে এত অবিশ্বাস্য সব ঘটনা দেখেছি, কিছুই আর অবাক করে না। এবারই প্রথম নয়, ২০০৬ সালে না হওয়া নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগ ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে ঐক্য করেছিল। বিএনপি-জামায়াতের সাথে জোট বেধে ভোট পাচ্ছে ভেবে আওয়ামী লীগও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কাছে টেনেছে বিভিন্ন সময়। লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ