মাসুদ রানা: ঢাকায় থাকতে, রজমান মাসে মহসীন হল থেকে আমি পুরান-ঢাকায় আমার বন্ধু রফিকের পারিবারিক দোকানে যেতাম ঢাকাইয়া ইফতারি খেতে। রফিকও ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র, কিন্তু আমরা বন্ধু ছিলাম জগন্নাথে ইণ্টারমিডিয়েট-পড়া কাল থেকে। রফিকের নেতৃত্বে লেবুর শরবত-পান দিয়ে রোজা ভাঙ্গা হতো এবং ভক্ষণ শুরু হতো পিঁয়াজো, ছোলাভাজা, পিঁয়াজ, কাঁচামরিচ, আদা, লেবু, ধনেপাতা, সরিষার তেল, ইত্যাদি দিয়ে মুড়ি-মাখা দিয়ে। মুড়ি-মাখা ছিলো ইফতারীর স্টার্টার। তারপর হতো হালিম, তিহারি কিংবা হাজীর বিরানী খাওয়া। সবশেষে পূর্ণিমার রসালো জিলাপি দিয়ে শেষ করা। দারুণ স্বাদের ছিলো সেই ইফতারি। যদিও ভাজা-ভাজির আধিক্যের এ-খাবার স্বাস্থ্যসম্মত ছিলো কি-না তা এখন ভাবি, কিন্তু তখন নিশ্চয় উপভোগ করতাম।
আমি যে রোজা রাখতাম না, তা জানার পরও আমার বন্ধুরা আমাকে বরং খাবারে অগ্রাধিকারই দিতো। গ্রেইটার সিলেটে মেথির পাতলা খিচুরি ছাড়া ইফতারের এবং পিঠা ছাড়া ঈদের কোনো কনসেপ্ট নেই। বিষয়টি আমার দারুণ বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। উপোস করার পর অনেকে মিলে একত্রে আহার করার মুসলিম সংস্কৃতিটি আমার ভালোই লাগে। আরও ভালো লাগে রোজদার-বেরোজদার কিংবা স্বধর্মীয়-বিধর্মীয় নির্বিশেষে সবাইকে এই সম্মিলিত আহারে আহবান করে ভাগ দেওয়ার সেক্যুলার ও সাম্যবাদী চর্চাটিও প্রশংসনীয়। কিন্তু রমজানে লোকেদের খাদ্যভোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর সে-কারণেই, স্মিথিয়ান অর্থনীতির সূত্র অনুসারে খাবারের দাম বেড়ে যায়। আমি ভাবিঃ দরিদ্র শ্রেণির লোকেদের রমজান মাস কীভাবে কাটে?
আমার শ্রেণিগত অবস্থানের কারণেই আমি কখনও জানিনি রমজানে দরিদ্রের অবস্থা কী হয়। আশ্চার্য্য, দরিদ্র শ্রেণির মুক্তির রাজনীতি করতে গিয়ে কারাবন্দীও হয়েছি, কিন্তু দরিদ্র শ্রেণির জীবন-যাপন সম্পর্কে কোনো ব্যবহারিক জ্ঞানই আমার ছিলো না। যতোই বয়স হচ্ছে, ততোই নিজের অতীত আচরণে ও চরিত্রে স্ববিরোধিতা বুঝত সক্ষম হচ্ছি। অবশ্য, এ-বুঝাতে আমার কোনো অনুশূচনা নেই। সময়ের, পরিস্থিতি ও বোধের ফল হিসেবেই স্বাভাবিক মেনে নিচ্ছি। আর, নিজেকে নিরপেক্ষভাবে বুঝতে পারছি বলে একটা মুক্তির স্বাদও পাচ্ছি। লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড