শিরোনাম
◈ লোকসানে ধুঁকছে পুঁজিবাজার, বন্ধ ৩০ হাজার অ্যাকাউন্ট, নিষ্ক্রিয় ৫৭ হাজার বিনিয়োগকারী! ◈ কীভাবে বিদেশে গেলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, তদন্তে তিন উপদেষ্টার সমন্বয়ে কমিটি ◈ এলডিসি থেকে উত্তরণে দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার ◈ ভুটানকে হা‌রি‌য়ে সাফ চ‌্যা‌ম্পিয়নশী‌পের সেমিফাইনালে বাংলাদেশ ◈ মিরপু‌রে কারাতে খেলায় খেলোয়াড়দের সঙ্গে সমর্থকদের সংঘর্ষ ◈ রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ১৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অব্যাহতি ◈ যশোর-বেনাপোল সড়কে ট্রেন-ট্রাক সংঘর্ষে আহত ২, দুই ঘন্টা রেল চলাচল বন্ধ ◈ সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধের বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাস বিরোধী অধ্যাদেশ অনুমোদন ◈ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক: মির্জা ফখরুল ◈ বাসিত আলীর প্রস্তাব: পা‌কিস্তান সুপার লি‌গের বা‌কি খেলা বাংলাদেশে আয়োজন করা হোক

প্রকাশিত : ২১ মার্চ, ২০২৩, ১২:৩৫ রাত
আপডেট : ২১ মার্চ, ২০২৩, ১২:৩৫ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র

কাকন রেজা 

কাকন রেজা: প্রথম আলোর একটি খবর। শিরোনামটি এমন, ‘হেলিকপ্টার থেকে নামলেন বর-কনে, হাতিতে চড়ে বাড়িতে গেলেন বর’। এ ধরনের শিরোনাম একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশের চিত্র তুলে ধরে আমাদের সামনে। তার বিপরীতে আরেকটা খবর এবং সেটাও প্রথম আলোর। এ খবরের শিরোনাম ছিলো, ‘অভাবের তাড়নায় জুসের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে ছেলেকে হত্যা’। প্রথম আলো এই শিরোনামটি ব্যবহার করেছে পুলিশের ভাষ্যে। দুটি খবরের মধ্যে সময়ের পার্থক্য মাত্র একদিন। প্রথমটি ১৯ মার্চের, পরেরটি তার একদিন আগের অর্থাৎ ১৮ মার্চের। কী বলবেন, একদিনেই জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় এ দেশের মানুষ অভাবী থেকে শেখে পরিণত হয়েছে! যেমন হয়েছেন দুবাইয়ে থাকা আরাভ খান। যিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যায় অভিযুক্ত হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। তারপর ভূতের রাজার বরে ধনকুবেরে পরিণত হয়েছেন। 

প্রথম আলোর শিরোনামের বর-কনে প্রবাসী। কিন্তু দেশেও হেলিকপ্টারে করে বিয়ে ভূতের রাজার বর পাওয়া কিছু মানুষের জন্য ট্র্যাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভাবের তাড়নায় সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যা বিপরীতে হেলিকপ্টারে করে বিয়ে। অভাব আর আতিশয্যের এমন কন্ট্রাস্ট সম্ভবত বিশ্বের আর কোনো দেশে চোখে পড়বে না। প্রশ্ন করতে পারেন ভূতের রাজার বর বিষয়ে কিংবা এমন বৈপরীত্যের কারণ নিয়ে। ভূতের রাজার বরের কথা বলতে গেলে, যারা এক দশকে সাধারণ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন, তাদের এই উত্থানের উপায়টা কি অর্থনীতি জানে? জানে না। শুদ্ধ অর্থনীতির ভাষায় এ অসম্ভব। সুতরাং এখানে ভূতের রাজার উপস্থিতি জরুরি এবং উত্থানের জন্য প্রয়োজন তার বর। এই বরে সৃষ্টি হয়েছে এক অকল্পনীয় এবং অসম্ভব ধরনের বৈষম্য। আমরা যারা অর্থনীতি কম বুঝি, জ্ঞান-বুদ্ধি কম, তাদের সাদা চোখেও তা সহজে ধরা পড়ে। পড়ে না শুধু কালো চশমাপরা কিছু মানুষের চোখে। দেশের অল্পকিছু মানুষ এতো ধনী হয়ে উঠেছেন যে, তাদের শান-শওকতের নিচে চাপা পড়ে গেছে সিংহভাগ মানুষের দারিদ্র্য। তাদের উৎসবের আতিশয্যে চাপা পড়ে গেছে অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার। 

কীভাবে ধনী হলেন এসব মানুষ এই প্রশ্নটার উত্তর দিতে দ্বিধাগ্রস্ত আমাদের অর্থনীতিবীদরা। দু’একজন আড়েঠারে কিছুটা বলতে চেয়েও একটা জায়গায় এসে আটকে যান। কেন যান তা সবাই জানলেও বলায় রয়েছে অদৃশ্য বারণ। তা থাক, আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখি। আবু সালেহ যেমন তার ছড়ায় বলেছিলেন, ‘বাঁচতে চেয়ে খুন হয়েছি বুলেট শুধু খেলাম/ উঠতে এবং বসতে ঠুঁকি দাদার পায়ে সেলাম’। 

যে বর-কনে হেলিকপ্টারে করে আসলেন তারা কারা। তারা হলেন যুক্তরাজ্যের অধিবাসী। আমরা যাদের সহজ ভাষায় বলি, প্রবাসী। তারা আসেন দেশে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে। তাদের শান-শওকত দেখাতে। আমরাও দেখি এবং ধন্য হই। এতে দোষের কিছু নেই। কারণ তারা ভাগ্য বদলাতেই বিদেশে গিয়েছেন। দেশে ভাগ্য বদলানোটা সম্ভব হলে হয়তো দেশেই থাকতেন। এই যে অর্থনীতিবিদরা এত রেমিটেন্সের কথা বলেন, সেই রেমিটেন্সের পেছনের গল্প হলো ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা। দেশে যদি ভাগ্য বদলানো সহজ হতো, তাহলে ইতালি যেতে সাগরে ডুবে মরতেন না বাংলাদেশিরা। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হতো না তাদের। 

যারা ভাগ্য বদলাতে প্রবাসী হয়েছেন, তারা তাদের পরিবর্তিত ভাগ্য প্রদর্শনের চেষ্টা করবেন এটাই স্বাভাবিক। মানুষের এই প্রদর্শনবাদীতা সহজাত। একসময় যেমন লাখেরবাতি জ্বালানো অনেকটাই সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছিলো। সে সময় যদি কেউ লাখপতি হতেন, তাহলে তার জানান দিতে অসংখ্য মাটির প্রদীপ জ্বালাতেন তারা। একেই বলা হতো লাখেরবাতি। সুতরাং যারা ভাগ্য পরিবর্তন করতে পেরেছেন এবং তা বৈধ উপায়ে তা প্রদর্শনে একরকম আনন্দ রয়েছে। রয়েছে আত্মতৃপ্তিও।

এখন এই শুদ্ধ আনন্দের বিপরীত বিষয়ে আসি। পুলিশ খুনে অভিযুক্ত একজন আরাভ খান দেশ থেকে দুবাইয়ে পৌঁছেন এবং সেখানে হয়ে উঠেন ধনকুবের। এই যে ধনকুবের হওয়ার প্রক্রিয়া তা ভাগ্য পরিবর্তনের সৎ ও শুদ্ধ চেষ্টা থেকে নয়। এটা সাধারণ মানুষের ভাগ্য কেটে নিজের ভাগ্যে জুড়ে নেয়ার অসৎ প্রক্রিয়া। আমাদের যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তা এই অসৎ প্রক্রিয়ার ফল। আমাদের দেশের কিছু মানুষ বিশ্বে ধনী হওয়ার সূচকে প্রথম হয়। আশ্চর্য হবার মত বিষয় নয়? যে দেশে অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যা এমনকি সন্তান বিক্রি ও হত্যার মতন খবর হয় গণমাধ্যমে, সেখানের মানুষ বিশ্বে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় অ্যামেরিকা, চীনসহ সব দেশকে পেছনে ফেলে দেয় এরচেয়ে আশ্চর্যের আর কি আছে।

আমাদের দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র পাওয়া কি খুব কঠিন? এই ভয়াবহ বৈষম্যের চিত্র তুলে আনা কি অসম্ভব? মোটেই নয়। যখন একজন রিকশাওয়ালার উক্তি গণমাধ্যম তুলে ধরে এ ভাবে, ‘কলা আর রুটি খেতেই পঞ্চাশ টাকা শেষ’। যখন বলা হয়, ‘ডিমও এখন ভাগ্যে জোটে না’। মাত্র ছয়মাসের ব্যবধানে ফার্মের মুরগির দাম স্রেফ দ্বিগুন হয়ে যায়। তখন অর্থনীতির চিত্র বুঝতে জটিল ধরনের সমীকরণের প্রয়োজন পড়ে না, হতে হয় না নামী-দামী অর্থনীতিবীদ। এই বৈষম্য এতটাই দৃশ্যমান এবং প্রকট তা তুলে ধরতে অমর্ত্য সেন সাজতে হয় না। হিসেবে কষতে হতে হয় না রামানুজন। বিপরীতে যারা নানান তত্ত্ব আর যুক্তিতে এই বৈষম্যকে আড়াল করার চেষ্টা করেন এবং যে চেষ্টা নিরন্তর। তারা স্রেফ জ্ঞানপাপী। আনুগত্য ও লোভ তাদের অন্ধ ও বধির করে দিয়েছে। এদের আমরা সবাই চিনি। কিন্তু নাম বলতে মানা। আমরা মূলত রামগরুড়ের ছানা হয়ে আছি। একটা কথা প্রচলিত হয়েছে না, ‘নাম বললে চাকরি থাকবে না’। ওই যে কথা সেই, যেটা বলেছিলেন ছড়াকার আবু সালেহ, ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা...।’ লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।   

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়