অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন: নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে আমাদের সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামগুলোর মূল থিম হলো ‘সব শিক্ষার্থী এখনো টেক্সট বই পাওয়ার বাকি, সব শিক্ষক এখনো ট্রেনিং পাওয়ার বাকি’। যেন ট্রেনিং আর বই পাওয়ার বাকিই হলো নতুন শিক্ষাক্রমের সমস্যা। এই শিক্ষাক্রমের সমস্যা আরো গভীরে একদম ফান্ডামেন্টাল লেভেলে আর এর মূলনীতিতে। একটি দেশের শিক্ষা নানা ধারাতে বিভক্ত থাকে। এর মধ্যে মূল ধারা থাকে নদীর ধারার মতো একটি এবং সেখান থেকে শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়। একটি দেশের মূল ধারার মূল উদ্দেশ্য থাকে সেই শিক্ষার মাধ্যমে দেশে যেন জ্ঞানের সকল শাখায় থিঙ্ক ট্যাংক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক তৈরি হয়। সারা পৃথিবীতেই এই শাখা প্রশাখায় বিভক্তি আছে। আমাদের স্কুল কলেজের বাংলা মাধ্যমের বর্তমান কাররিকুলামেও তা আছে যেমন মূল ধারা থেকে কারিগরি ধারায়, ভোকেশনাল ধারায় বিভক্তি। বর্তমান নতুন যেই শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে তার মাধ্যমে ফান্ডামেন্টাললি কি করা হচ্ছে? মূল ধারাকেই কারিগরি ধারার দিকে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই কাররিকুলাম দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় নতুন এই শিক্ষাক্রম যারা চালু করতে যাচ্ছে তারা বুঝে হোক না বুঝে হোক একটি বা দুটি উদ্যেশ্যকে সামনে রেখে নতুন এই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্যগুলো: উদ্যেশ্য ১: আমাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে এমনভাবে শিখবে যেন স্কুল পাসের পরেই কিছু একটা করে খেতে পারে। এইরকম স্বল্প মেয়াদি উদ্দেশ্য থাকে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে। মূল ধারার শিক্ষার উদ্দেশ্য থাকবে সুদূর প্রসারী আর এই উদ্দেশ্য হাসিল হবে দীর্ঘ মেয়াদে। আমরা স্কুলে ঐকিক অংক করার সময় বা অন্য কোনো বিষয় পড়ার সময় যদি সর্বদা প্রশ্ন করতে থাকি, এই অংকটা করে বা এই বিষয়টা পড়ে কী লাভ তাহলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। মূল ধারার স্কুল কলেজের কারিকুলাম এমন হবে যেন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উচ্চতর লেখাপড়া করতে অসুবিধা না হয়। এখন স্কুলের কারিকুলামে বিজ্ঞান কমিয়ে ও উচ্চতর গণিত বাদ দিয়ে বিজ্ঞানকে বনসাই বানানোর চেষ্টা হয়েছে। বিজ্ঞানের আগে প্রযুক্তিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের টেকনিশিয়ান বানানো হবে বিজ্ঞানী নয়। মূল ধারার শিক্ষাকে কারিগরি লেভেলে নামানো হচ্ছে। নতুন কাররিকুলামে আপাত চাকচিক্য থাকলেও দীর্ঘ মেয়াদে এর অনেক কুফল আসবে যা আমাদের সাধারণ মানুষ এখন ততোটা বুঝবে না। আর আমাদের আমলা মন্ত্রীরা যেই মানের তাতে আমি নিশ্চিত তারাও বুঝেনি।
উদ্দেশ্য ২: দেশে এলিট নন-এলিট বিভাজন তৈরী। দেশে ধনী গরিবের ফারাক বৃদ্ধি। দেশকে বিশ্বের উদ্ভাবনী রাষ্ট্রগুলোর বাজার বা ভোক্তা হিসাবে তৈরী করা। উন্নত দেশ উদ্ভাবন করবে আর আমরা সেইসব ব্যবহার করে স্মার্ট সিটিজেন হব। ঢাল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ জয় করে সাম্রাজ্য বাড়ানোর দিন শেষ। এখন জ্ঞানের মাধ্যমে, কূট নীতির মাধ্যমে অন্য দেশকে বাজার বানানো আর দেশ জয় সমার্থক। এখন আসুন দেখি আমাদের নীতিনির্ধারকরা নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু করতে গিয়ে দেশের মানুষের মঙ্গলের কথা কতটা ভেবেছে। একটু আগেই প্রথম আলোর একটি সংবাদ পড়লাম। সংবাদটির লেখক নাদিম মাহমুদ। সংবাদটির শিরোনাম হলো "সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বই: হুবহু চুরি আর গুগলের অনুবাদে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে?" কি ভয়াবহ সংবাদ বুঝতে পারছেন? পুরো সংবাদটি পড়ে বুঝলাম আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রণীত জাতীয় টেস্ট বইয়ে চৌর্যবৃত্তি হয়েছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে বিদেশি ভাষায় লেখা প্রাপ্তি স্বীকার না করে হুবহু গুগল ট্রান্সলেট করে মেরে দিয়েছে। এইটাকে যদি চৌর্যবৃত্তি না বলি তবে চৌর্যবৃত্তি আর কাকে বলব? নাদিম মাহমুদের লেখা আজকের প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখাটি সকলের পড়া উচিত। এতদিন আমি শিক্ষাক্রম নিয়ে যেইসব কনসার্ন জানিয়েছি তার সাথে এই চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ যোগ হলো।
অথচ এই টেক্সট বইয়ের লেখক হিসাবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তারা দেশের বরণ্য ব্যক্তিত্ব। যেমন লেখক হিসাবে নাম আছে অধ্যাপক জাফর ইকবালের নাম, অধ্যাপক হাসিনা খানের মত বিজ্ঞানীর নাম। আমার সন্দেহ হলো তাদের নামগুলো কেবল অলংকার হিসাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দলান্ধতার সমস্যা এইখানেই। দলান্ধ হলে দল ক্ষমতায় গিয়ে যা কিছু করুক তাকে সার্টিফাই দেওয়াই হলো দলান্ধদের কাজ। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে কাদের নাম ব্যবহার করা হতো আর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলে কাদের নাম ব্যবহার হবে এইগুলো আমাদের মুখস্ত। এইজন্যই বলি বড় বড় শিক্ষাবিদদের দলান্ধ হতে নেই। একটি রাষ্ট্রের কিছু মানুষ থাকতে হয় যারা সমস্যার পুরো স্পেকট্রাম দেখতে পারে। আমাদের সরকারগুলো খুদকুঁড়া ছড়িয়ে, তাদের অভাব অনটনে রেখে তাদের চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছে। একটি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার যোগ্যতা যদি হয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দুই একবার নির্বাচনে জয়ী হওয়া, শিক্ষক হিসাবে বা গবেষক হিসাবে কত ভালো তা বিবেচনায় না নেওয়া সেই দেশে আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। তাই আমি সরকারকে বলব অবিলম্বে এই নতুন শিক্ষাক্রম বন্ধ করুন। এই শিক্ষাক্রম জাতি ধ্বংসের শিক্ষাক্রম। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। লেখক: শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়