আরিফ রহমান: মৌলবাদ আর গুডউইলের পার্থক্য খুব জটিল কিছু না। আমাদের বিজ্ঞানমনস্কদের মৌলবাদ থেকেই একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা বোঝা যাবে। ধরেন আমাদের এই অঞ্চলে তো প্রচুর ভেজিটেরিয়ান মানুষজন আছেন। এই ভেজিটেরিয়ানদের নিয়ে বিজ্ঞানমনস্কদের ট্রলের শেষ নাই। কারণ গাছের জীবন আছে। গাছ কাটলে গাছও ব্যাথা পায়। এই কথাটা বলে আমরা একখণ্ড হাসি দেই। আমরা যে পশুপাখিদের প্রতি ভায়োলেন্সের বিষয়টা একেবারেই বুঝি না তা কিন্তু না। এই ভেজিটেরিয়ান লোকগুলো যে একটা শুভচিন্তা বা গুডউইল থেকে মাংসটা খায় না সেটা আমরা ঠিকই বুঝি। একটা পাগলও জানে মাংস খাইতে বেশি মজা নাকি মূলা।
আমরা যারা হেভি ননভেজিটেরিয়ান, আমাদের উচিত ছিল আমাদের ফ্রি উইলে মাছ-মাংস কনজিউম করা। আর যারা ফ্রি উইলে এটা করতে চায় না তাদেরকে তাদের ইচ্ছেমত চলতে দেয়া। পাশাপাশি তারা যে তাদের রিপুকে কষ্ট করে কন্ট্রোলে রাখসে সেটার জন্য তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। কারণ বিষয়টা সিম্পল লজিকের না। বিষয়টা এম্পেথির। কাটলে ব্যাথা লাগে। আমার যেমন লাগে গরুরও তেমনই লাগে।
এই ভেজিটেরিয়ানদের ভেতরেও অনেকরকম গ্রুপ আছে। সবচেয়ে এক্সট্রিম হচ্ছে জৈনধর্ম শক্তভাবে পালন করা সাধুরা। তাঁরা মূলা, পেঁয়াজ, আলুর মত ভেজিটেবলও খান না। যেই ভেজিটেবল খাওয়ার জন্য পুরো গাছটাকে জীবন দিতে হয় সেই ভেজিটেবল তাঁরা খান না। তাঁরা মটর খান। একটা মটর গাছ থেকে একটা মটরদানা তুলে নিলে গাছটা হয়তো একটু কষ্ট পাবে, কিন্তু তার প্রাণটা চলে যাবে না। মানে ঐ যে গাছের জীবন আছে বলে আপনার ফিক করে হেসে দেয়া, এই দেখেন স্ট্রিক্ট জৈনধর্মালম্বীরা কিন্তু এটা কনসিডার করে। জৈন ধর্মে একেবারে আদিকাল থেকে পানি কয়েক স্তর কাপড়ের ভেতর দিয়ে ফিল্টারিং করে খাওয়ার নিয়ম। যাতে পানির সাথে মিশে থাকা মাইক্রো অর্গানিজম আমরা খেয়ে না ফেলি। এবং নিয়ম হচ্ছে যেই কাপড় দিয়ে ফিল্টারিং করা হয় সেই কাপড়টা আবার একটা ছোট মটকায় চুবিয়ে রাখা হয়। যেন মাইক্রো অর্গানিজমগুলো বেঁচে থাকতে পারে।
জৈনরা মুখে মাস্ক পরেন যেন নিঃশ্বাসের সাথে বায়ু বাহিত অণুজীব যত কম সম্ভব মারা পড়ে। জৈন সাধুরা যখন হাঁটেন তখন একটা ছোট ঝাড়ু দিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তার পোকা-মাকড় আর পিঁপড়া সরাতে সরাতে হাঁটতে থাকেন। যেন তাদের পায়ের নিয়ে চাপা পড়ে কোন জীবের মৃত্যু না হয়। জৈন সাধুরা যত সম্ভব যানবাহনে চলাচল এড়িয়ে চলেন, কারণ এসবের নিচে চাপা পড়ে অনেক ছোট জীব মারা পড়ে।
প্রাচীন শাস্ত্র অনুসারে জৈন সাধুদের এক স্থানে একদিনের বেশি থাকার নিয়ম নেই। যেন যেখানে তাঁরা থাকবেন সেই জায়গার প্রতি তাদের কোন মায়া না জন্মে। যাদের বাড়িতে তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন তাদের কষ্ট না হয়। এজন্যই জৈন টেম্পলের সংখ্যা খুব কম। এই যে এতো সিরিয়াস নিয়ম-কানুন, এগুলো বাস্তবতার সামনে অনেকটাই অকেজো। আর এই কারণেই এই ধর্মটা প্রচার হয় নাই বেশি। রাস্তা পরিষ্কার করে হেঁটে হেঁটে কেউ কি এই জীবনাচার নিয়ে হিন্দুস্তান থেকে আমেরিকায় পৌঁছাতে পারবে বলে মনে করেন?
বিজ্ঞানমনস্করা বলতে পারেন তাদের জীবনটা তো অস্বাস্থ্যকর, কতোরকম ভিটামিন দরকার মানুষের দেহে। বলতে পারেন, এভাবে তো মানুষের হায়াতই থাকে না, কিন্তু একটা জিনিস নিশ্চিতভাবে থাকে, সেইটা হইলো গুডউইলের প্রতি তাদের কমিটমেন্ট ভালো। আপনি একজন বিবেকবান মানুষ। আপনি দাবী করেন আপনি দুনিয়ার গার্ডিয়ান জীব। তাইলে আপনি যদি বাঘের মত স্টিং দ্বারা তাড়িত হয়ে শুধু নিজের জীবসত্ত্বাকে সন্তুষ্ট করেন তাইলে তো আপনি আসলে সেই অর্থে গার্ডিয়ান হইলেন না আরকি। যাই হোক, সিরিয়াস জৈন ভেজিটেরিয়ান এখন দুনিয়ায় খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু একজন গর্বিত গরুখোর মুসলমান হয়েও আমি প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি জৈনদের এই গুডউইলকে স্বাগত জানাই। লেখক ও সাংবাদিক। ফেসবুক থেকে