মানবজমিনের প্রতিবেদন।। বাংলাদেশের পতিত সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনার ব্যাপারে ভারত ভিন্ন কৌশল নিচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকায় ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের অব্যাহত চাপের মুখে তারা নীরব। তবে, শেখ হাসিনার সঙ্গে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের দেখা-সাক্ষাৎ করতে দিচ্ছে না। এমনকি হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনও করতে দেয়নি। যদিও এ নিয়ে ভারতের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে ভিন্নমত স্পষ্ট।
প্রফেসর ইউনূসের সরকার সম্পর্কে মোদি সরকারের ধারণা মোটেই ভালো নয়। হাসিনার পতনের পর ইউনূস সরকারকে স্বীকৃতি দিতে নরেন্দ্র মোদি খুব একটা দেরি করেননি। মোদি সরকারের ধারণা বাংলাদেশ তার গতিপথ হারিয়েছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন, দেশটি পাকিস্তানের পথ ধরেছে। ইউনূস সরকারের ভেতরে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়াও লক্ষ্য করা যায়। মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডির পর ভারত একদল চিকিৎসক পাঠিয়ে মানবিকতা দেখিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখতে নানাবিধ কঠোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছে। ভিসা বন্ধ করেছে। সীমান্তে মানুষ হত্যা অব্যাহত রয়েছে। পুশ-ইন এখন নিত্যদিনের ঘটনা। দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এখন হিমশীতল। বাংলাদেশ একজন ঝানু কূটনীতিককে হাইকমিশনার হিসেবে দিল্লিতে পাঠিয়েছে। তিনি দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। কিন্তু বরফ গলছে না। ওয়াকিবহাল কূটনীতিকরা বলছেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের গতি-প্রকৃতির উপরেও অনেকখানি নির্ভর করে। ভারত আগাগোড়াই সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন চাচ্ছে। অবশ্য তা এই সরকারের আমলে। বিগত পনের বছর ভারত নির্বাচন সম্পর্কে একতরফা নীতি গ্রহণ করেছিল।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রচণ্ড দেন-দরবারও করে দেশটি। ২০২৩ সনে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত-আমেরিকা বৈঠকটি সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ভারত চাইছিল ওয়াশিংটন যাতে এ নিয়ে নাক না গলায়। পরিণতিতে ওয়াশিংটন অনেকটাই চুপ থাকে। মুখপাত্রের কিছু প্রতিক্রিয়া বাদে ওয়াশিংটন তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।
হাসিনার পতনের পর ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা বলছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করাটা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। আর এ কারণেই বাংলাদেশ তাদের হাতছাড়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মানুষ হয়েছে ভারতবিরোধী। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা শক্তি নেই যারা কিনা ভারতের পক্ষ নিয়ে কথা বলছে! এসব কারণেই হয়তো ভারত তার বাংলাদেশনীতি পরিবর্তন করতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলতে দিচ্ছে। কিন্তু সরাসরি কথা বলতে দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাক্ষাৎও হচ্ছে না দলীয় নেত্রীর সঙ্গে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ লন্ডন থেকে ভারতে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল হাসিনার সাক্ষাৎ। তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। সাক্ষাৎ হয়নি হাসিনার সঙ্গে।
ওবায়দুল কাদের তো চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত। জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে একবার যোগাযোগ হয়েছিল, তবে সেটা বেশিদূর এগোয়নি। হাসিনার পতনের জন্য গোয়েন্দা ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন হাছান মাহমুদ। ঢাকার গোয়েন্দারা বলছেন, তিনি তো আমাদের কথা বিশ্বাস করতেন না। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দাদের উপর শতভাগ নির্ভরশীল ছিলেন।
যাইহোক, বাংলাদেশের ঘটনাবলীর উপর নজর রাখছে ভারত। নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক মেরূকরণে তারা কিছুটা হতাশ। চরম দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে তাদের হিসাব-নিকেশ পাল্টে গেছে। অনেকেই বলছেন, এক ঝুড়িতে আম রাখার পরণতি হচ্ছে এটা। আওয়ামী লীগের বিকল্প তারা একবারও চিন্তা করেনি। যে কারণে হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতকেও চলে যেতে হয়েছে।
বিকল্প মাথায় রেখে ভারত এখন ঘুঁটি সাজাচ্ছে। হাসিনা নয়, তাদের এখন প্রয়োজন বাংলাদেশ। আর এটা হাসিল করার জন্য কৌশল বদল করছে । বিকল্প শক্তির সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে। নাটকীয় কোনো পরিবর্তন হলেও হতে পারে। তবে এটা ঠিক, সামনের মাসগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ‘সংকটময়’ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।