উৎপল কান্তি ধর : সন্দেহের অবকাশ নেই, মিষ্টিমুখেই পূর্ণ হয় ষোলআনা বাঙালিয়ানা। বাঙালি আর মিষ্টি সমার্থক। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণে মিষ্টির সাম্রাজ্য অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চিমবঙ্গের যেকোনও পাড়ার দিকে তাকান, নিদেনপক্ষে একটা মিষ্টির দোকান ঠিক থাকবেই। আসলে বিশ্বে যেখানে বাঙালি, সেখানে ঠিক মিলবে মিষ্টি। বাঙালির অতি প্রিয় একটি মিষ্টি হলো লেডিকেনি। জানেন কি এই মিষ্টির জন্ম কীভাবে হলো? লেডিকেনির উৎস জানতে হলে চলে যেতে হবে সুদূর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। ১৮১৭ সালে প্যারিসের একটি অভিজাত পরিবারে জন্ম নিলেন একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে। নাম শার্লট স্টুয়ার্ট। এর কিছুদিনের পর তাদের পরিবার চলে এলো লন্ডনে। লন্ডনেই পড়াশোনা করতে লাগলেন শার্লট স্টুয়ার্ট। শার্লট যখন সতেরো বছরের কিশোরী, তখন চব্বিশ বছরের চার্লস ক্যানিংয়ের সঙ্গে তার দেখা। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব, তারপর ভালোবাসা। এদিকে শার্লটের বাবা স্টুয়ার্ট ব্যারনের সাথে ক্যানিংয়ের বাবা, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিস্টার জর্জের বহুদিনের ঝামেলা। ফলে নাকচ হয়ে গেলো বিয়ে। এদিকে শার্লট-ও নাছোড়বান্দা। শেষমেশ তার জেদের কাছে হার মানল দুই পরিবার। বিয়ে হলো শার্লট স্টুয়ার্ট আর চার্লস ক্যানিংয়ের।
জর্জ এবং জোয়ান ক্যানিংয়ের কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন চার্লস ক্যানিং। জন্ম লন্ডনের ব্রম্পটনে। ১৮৩৬-এ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে হাউজ অব লর্ডসের সদস্য হন। গ্রেট ব্রিটেনের পোস্টমাস্টার জেনারেল হিসাবে কাজ করে তিনি প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দেন। এর কিছুদিন পরেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঠিক করলো গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির পরে ভারতের গভর্নর জেনারেল হোক চার্লস ক্যানিং। চার্লস ক্যানিং ও শার্লট ১৮৫৬ সালে ফ্রেব্রুয়ারিতে পা রাখলেন ভারতের মাটিতে। চার্লস ক্যানিং তখন হয়ে গেলেন লর্ড ক্যানিং আর শার্লট হয়ে গেলেন লেডি ক্যানিং। দুজনে ভারতের অধিবাসীদের ওপর গবেষণামূলক কাজ করেছেন।
১৮৫৭ ও ১৮৬৮ সালে তাদের এই কাজ ‘পিপল অব ইন্ডিয়া’ শিরোনামে নামে আটটি খণ্ডের বই আকারে প্রকাশ পায়। লেডি ক্যানিং ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর সহানুভূতিশীল ছিলেন। দারুণ ছবিও আঁকতেন। ১৮৫৮ সালে লর্ড ক্যানিং ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ভাইসরয় হিসাবে তিনি দায়িত্বভার নেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিংয়ে আজও আছে লর্ড ক্যানিং-এর বাংলো। একবার লেডি ক্যানিং এর জন্মদিন এল। লর্ড ক্যানিং ঠিক করলেন অতিথিদের একটা নতুন স্পেশাল মিষ্টি খাওয়াবেন। লেডি ক্যানিং-ও মিষ্টি খুব ভালবাসতেন। লর্ড ক্যানিং ডেকে পাঠালেন কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টির কারিগর ভীম নাগকে। বললেন একটা নতুন মিষ্টি বানাতে হবে। ভীম নাগ কিছুদিনের মধ্যেই বানিয়ে ফেললেন একটা নতুন মিষ্টি। জন্মদিনে সেই মিষ্টি খেয়ে খুশি হলেন অতিথিরা। লর্ড ক্যানিং খুশি হয়ে ভীম নাগকে অনেক পুরস্কারও দিলেন।
লেডি ক্যানিং ১৮৬১ সালে দার্জিলিং যেতে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। ব্যারাকপুরে তাঁকে সমাহিত করা হল। পরে সেই সমাধি সরিয়ে আনা হয় কলকাতার সেন্ট জন্স চার্চে। তারপর লর্ড ক্যানিংও ফিরে গেলেন স্বভূমিতে। লেডি ক্যানিং এর জন্মদিনে জন্ম নেওয়া সেই মিষ্টি বাংলার মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল। মানুষের মুখে মুখে হয়ে গেল ‘লেডিকেনি’। এভাবেই জন্ম নিলো ‘লেডিকেনি’। সূত্র : অহর্নিশ। ফেসবুক থেকে