ফরিদ আহমেদ: প্রচলিত একটা কৌতুক আছে। গ্রামের এক উঠতি বয়সী রোমিও ছেলে যখনই প্রেমে পড়ে, তখনই তার বাবা বলে যে, ওই মেয়ের প্রেমে পড়ো না, কারণ ও তোমার সৎ বোন হয়। তার মা আমার গোপন প্রেমিকা ছিলো। বাবার এমন রমণী-মোহন পরিচয় পেয়ে ওই ছেলে চরমভাবে হতাশ হয়ে একদিন তার মাকে গিয়ে বলছে যে, ‘বাবার কারণে তো দেখছি আমি প্রেমই করতে পারবো না’। ‘কেন, কী হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন হয়ে মা জিজ্ঞেস করেন। ‘আমি যে মেয়ের প্রেমে পড়ি, বাবা বলে যে সেই-ই নাকি আমার সৎ বোন। বাবার কারণে তো আমার প্রেম করাই দায় হয়ে পড়েছে’। ছেলের উদ্বেগ দেখে মা তো হেসে কুটি কুটি। ‘তুমি নিশ্চিন্তে এই গ্রামের যেকোনো মেয়ের সাথে প্রেম করতে পারো। কারণ তোমার বাবা বলে যাকে জানো তুমি, সে তোমার আসল বাবা না।’ এই কৌতুকটা জনপ্রিয় এক কারণে যে এর শেষে একটা চমক আছে। সেই সাথে আছে বাবার অনিয়ন্ত্রিত জীবনের জন্য একটা পালটা শিক্ষাও। তিনি নিজেই শুধু একতরফা অবিশ্বস্ত হননি, তার স্ত্রীও হয়েছেন। প্রচলিত এক কৌতুকে মূল যেটা উঠে এসেছে, সেটা হচ্ছে যৌন জীবনে পুরুষের অপরিসীম চাহিদা এবং অবিশ্বস্ততা। এই ধারণা অবশ্য আকাশ থেকে পড়েনি। চোখ কান খোলা রেখে চারিদিকে একটা তাকালেই এর সত্যতা টের পাওয়া যায়। পুরুষের মধ্যে বহু নারীকে পাবার এক তীব্র আকাক্সক্ষা কাজ করে। সুযোগ পেলেই অবিশ্বস্ত হয় তারা। নারীদের মধ্যে এই চাহিদা তুলনামূলকভাবে কম।
গবেষক ডেভিড বাস তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে এক হাজার জন নারী-পুরুষের উপরে একটা গবেষণা চালিয়েছিলেন। সেই গবেষণায় দেখা যায় পুরুষরা পরবর্তী তিন বছরে আটজন যৌন সঙ্গী পাবার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছে। এর বিপরীতে নারীদের চাহিদা ছিলো মাত্র এক বা দুইজন পুরুষ সঙ্গী। অন্য এক গবেষণাতেও দেখা গেছে যে, পুরুষরা বহু নারীর সাথে যৌন মিলন করছেÑ এমন কল্পনা করে মেয়েদের যৌন কল্পনার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে। পুরুষের এই বহু সঙ্গী কামনার বাসনাকে আমরা বিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি সহজেই। প্রকৃতিতে পুরুষ বড় ধরনের একটা সুবিধা পায়। সন্তান গর্ভে ধারণ বা লালন পালনের দায়িত্ব থেকে মোটামুটি সে মুক্ত। এমন অবস্থায় তার জন্য জিন বিস্তারের সবচেয়ে সহজ রাস্তা হচ্ছে বহু সঙ্গীর কাছে যাওয়া। যতো বেশি সঙ্গীর কাছে সে যাবে, তার জিন ততো বেশি ছড়াবে। এমন একটা সুযোগ যার আছে, সে নিশ্চয়ই এক সঙ্গীর কাছে থেকে তার এই সুবর্ণ সুযোগকে নষ্ট করবে না। অন্যদিকে নারী প্রজাতিদের বেশিরভাগেরই এই রকম সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে স্তন্যপায়ী এবং এপদের ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি করে প্রযোজ্য।
মানুষের ক্ষেত্রেই আমরা এই বাস্তবতা সহজেই দেখাতে পারি। একটা সন্তান জন্ম দিতে একজন নারীকে নয় মাস তার গর্ভে সেই সন্তানকে রাখতে হয়। সন্তান জন্ম নেওয়ার পরেও তার মুক্তি নেই। সেই বাচ্চাকে স্তন দান করতে পারে, প্রতি মুহূর্তে যত্ন নিতে হবে। পুরুষদের এই দায়টা একেবারেই নেই। সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য কয়েক মুহূর্তের আলোড়নই তার জন্য যথেষ্ট। সন্তান জন্ম দেবার ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের প্রচেষ্টার এই সমুদ্রসম পার্থক্যের কারণে পুরুষদের মধ্যে নানা ফুলের মধু খাবার সুতীব্র তৃষ্ণা জন্ম নিয়েছে। প্রতিটা প্রচেষ্টাই তার জন্য বিবর্তনে প্রজননে সাফল্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। যে পুরুষ যতো বেশি নারীতে গমন করেছে, তার জিন ততো বেশি ছড়িয়েছে। উদাহরণ হিসাবে চেঙ্গিস খানের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এই লোকের জিনের মতো আর কোনো জিন ছড়ায়নি। পুরুষদের মতো ইচ্ছা করলেও কোনো নারীও অসংখ্য পুরুষ সঙ্গীর কাছে যেতে পারে। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে, এতে করে প্রজননে তার কোনো সাফল্য আসবে না। হাজার পুরুষ সঙ্গী থাকলেও নয় মাসে ওই একটা সন্তানের বেশি সন্তান সে জন্ম দিতে পারবে না (যমজ কিংবা ত্রয়ী সন্তান হলে অবশ্য ভিন্ন কথা)। নারী এবং পুরুষের প্রজননে সাফল্যের এই ভিন্ন বাস্তবতাই পুরুষকে করে তুলেছে বহু নারী আকাক্সক্ষী। দীর্ঘস্থায়ী সঙ্গীর বাইরে গিয়েও স্বল্পস্থায়ী সঙ্গিনীদের দিকে ছুটেছে তারা।
এইটুকু পর্যন্ত ঠিক আছে। পুরুষ তুলনামূলকভাবে বহুগামী নারীদের তুলনায়। কিন্তু যে ধাঁধাটা সবচেয়ে বেশি সমাধানের অযোগ্য সেটা হচ্ছে পুরুষের বহুগামিতার জন্য নারীরও প্রয়োজন রয়েছে। এটা এমন এক খেলা, যে খেলা একা একা খেলা যায় না। নারী বহুগামী না হলে, পুরুষের বহুগামী ইচ্ছা কখনোই বাস্তবায়িত হবার কথা না। তাদের কল্পনা কল্পনা হয়েই থাকতো, বাস্তবের রূপ নিতে পারতো না। জোর জুলুম করলে ভিন্ন কথা। যেমনটা চেঙ্গিস খান করেছে। জোর জুলুমের বাইরে স্বেচ্ছায় হতে গেলে নারীকেও বহুগামী হতে হবে পুরুষের মতোই। পুরুষের মধ্যে যৌন ঈর্ষা প্রবল। এটা অবশ্য নারীদের মধ্যেও রয়েছে। নিজের সঙ্গিনীর দিকে অন্য কোনো পুরুষ আগ্রহ নিয়ে তাকালে কিংবা খুনসুটি করতে এলে, সে নিজের মধ্যে ঈর্ষার তীব্র স্রোত অনুভব করে। আদি যুগ থেকে নারীরা যদি একগামী হতো, পুরুষদের মধ্যে এই যৌন ঈর্ষা জন্ম নেবারই কথা ছিলো না। ঈর্ষা মূলত আসে ইনসিকিউরিটি থেকে। সঙ্গিনীর দিক থেকে অবিশ্বস্ত না হবার কোনো সংকেত না এলে পুরুষদের মধ্যে এই অনুভূতির জন্মই নেবার কথা ছিলো না। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের আদি মাতাদের অনেকেই আমাদের আদি পিতাদের চোখ এড়িয়ে অন্য কোনো পুরুষের দিকে তাকিয়েছেন। ফলে, আমাদের আদি পিতারা অস্বস্তিতে ভুগেছেন, ক্ষিপ্ত হয়েছেন, ঈর্ষার আগুনে পুড়েছেন তারা। সেই ঈর্ষার নদীকেই এখনো বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমরা বুকের মধ্যে করে। ওই ভয়ংকর ঈর্ষার কারণে সঙ্গিনীকে মারধোর করা, খুন করে ফেলা কিংবা তার চোখ তুলে নেওয়াও কোনো ব্যাপার না পুরুষদের কাছে। ফেসবুক থেকে