শিরোনাম
◈ নিষেধাজ্ঞা শিথিল হতে পারে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সফরে ◈ সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ◈ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও পাঁচ নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি ◈ ঢাকার ২৬টি হোটেল-রেস্তোরাঁয় পুলিশ সদস্যদের জন্য মূল্য ছাড়  ◈ বনানীর আগে বাসে যাত্রী তুললেই মামলা: ডিএমপি কমিশনার ◈ লু’র সফরকে কেন্দ্র করে ওবায়দুল কাদের সাহেবরা অস্থিরতায় ভুগছেন: রিজভী ◈ ‘জেনোসাইড জো’: যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিক্ষোভ বাইডেনের পুনর্নির্বাচনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে ◈ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড দেশের ওপর ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে: টিআইবি ◈ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাবেক বাপেক্স এমডির সাক্ষ্য ◈ তাসকিনকে সহ অধিনায়ক করে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল ঘোষণা

প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ০১:১২ রাত
আপডেট : ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ০১:১২ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

অনেক লোক একসঙ্গে হলে তবেই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো ঘটে

মোজাফ্ফর হোসেন

মোজাফ্ফর হোসেন: আমরা প্রায় সর্বক্ষেত্রে গণসমর্থনের কথা বলি, জনমতে ভরসা করি। একসঙ্গে অধিক মানুষ মিলে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, এই আমাদের বিশ্বাস। বাবা বলতেন ‘জনমতে বিশ্বাস হারানো পাপ’। তখন তো বাবার সঙ্গে তর্ক করিনি। সরল বিশ্বাসে ভেবেছি, একশ লোক একসঙ্গে হলে ভুল সিদ্ধান্ত নেবেই-বা কেন? কিন্তু এখন বুঝি, অনেক লোক একসঙ্গে হলে তবেই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডগুলো ঘটে। ব্যক্তিমানুষের চেয়ে আরো বেশি জোশ নিয়ে অহেতুক, অযৌক্তিক, অমানবিক কাজ করতে পারে সম্মিলিত জনতা। জনমত বা জন-সিদ্ধান্ত মানেই যে সঠিক, সেটি আর একদম মনে করি না। বরঞ্চ মূর্খ ভণ্ড সমাজে একক-ভাবে একজনে বা মাত্র কয়েকজন মিলে সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেন। সক্রেটিস বিশ্বাস এনেছিলেন জ্ঞান ও দর্শনে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সমাজ, মানে সংঘবদ্ধ: জনতা। ব্রুনো বিশ্বাস করতেন পৃথিবী সমতল নয় গোল, তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে; কোপার্নিকাস-গ্যালিলিও মনে করেছেন সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে; তাদেরও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত শাসকগোষ্ঠীর, এবং গণসমর্থনের জোরেই সেগুলোর বাস্তবায়ন ঘটেছে। কিন্তু এইসব ক্লাসিক দৃষ্টান্ত না। আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে খুব সাধারণ দুয়েকটি ঘটনা। সক্রেটিস-হত্যার মতো এইসব ঘটনা ইতিহাসের কোথাও লিপিবদ্ধ থাকবে না।
তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। শহরের বাইরের একটি স্টেশনে ছেলেধরা সন্দেহে এক মানসিকভারসাম্যহীন নারীকে পিটিয়ে মারল জনতা। না, সেই ভিক্ষুক নারীটি বোঝাতে পারেনি, ছেলেটি তারই। সে অন্যকারো ছেলেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে না। সম্মিলিত জনতা রায় দিল এবং সম্মিলিত জনতা সে রায় বাস্তবায়ন করল। ঘটনাস্থলেই অবুঝ সন্তানের সামনে মারা গেল সেই সন্তানের মা। সন্তানটি বড়ো হলে কার কাছে বিচার চাইবে, কাকে দায়ি করবে তার মায়ের খুনি হিসেবে? তখন ভেবেছিলাম গ্রামের ‘অশিক্ষিত মানুষ’ সম্মিলিতভাবেও ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ‘অশিক্ষিত মানুষ’ একজনও যা, একশো জনও এরকম একটা গড় ধারণা করে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম।কিন্তু এরপর ঘটে আরও একটি ঘটনা: নিজের চার বছর বয়সী সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর খবর জানতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান মা তাসলিমা বেগম রেনু। এবার আর ঘটনাটি গ্রামে ঘটেনি। ঘটেছে রাজধানীতে। শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে। তাসলিমা বেগম একবারও বোঝাতে পারেননি, তিনি ছেলেধরা না, তিনি সন্তানের মা। আমরা সেই ঘটনা ভুলে গেলেও দুটি প্রাণ আজীবন আমৃত্যু মনে রাখবে, তাসলিমা বেগমের দুই শিশুসন্তান। কিন্তু কি মনে রাখবে তারা? তাদের মায়ের হত্যাকারীদের সম্পর্কে জানতে চাইলে ওরা কি জবাব দেবে? জনতার সিদ্ধান্ত ও সম্মিলিত সহিংসতার কারণে আজ দুটো শিশুর জীবন ওলটপালট হয়ে গেল। দায়টা কার?
সম্মিলিত জনতা কতটা নৃশংস পাশবিক হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখলাম ভারতের মণিপুরে। এই ঘটনার বিবরণ লেখা অসম্ভব। যে আমি মানুষ মানুষের মাংস খাওয়ার গল্প লিখতে পারি, মানুষের মাথা কেটে নিয়ে শিশুদের ফুটবল খেলার গল্প লিখতে পারি, তার পক্ষেও এই ঘটনার বিবরণ লেখা সম্ভব না। দুই নারীকে বিবস্ত্র করে রাস্তায় হাঁটানো এবং প্রকাশ্য সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটাল সংঘবদ্ধ জনতা; ভাবা যায়? ২০২০ সালে আগে লালমনিরহাটে কোরআন শরিফ অবমাননার গুজব ছড়িয়ে একদল বিক্ষুব্ধ জনতা এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। শত শত মানুষ জড়ো হয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারপর মৃত ব্যক্তির শরীরে আগুন দিয়েছে। নিহত আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন নবী মানসিক সমস্যায় ছিলেন বলে পরিবারের দাবি ছিল। অতি সম্প্রতি ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সন্দেহ থেকে দুই শ্রমিক ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করল জনতা। মন্দিরে আগুন কে দিলো সেটা আমরা কোনোদিনই জানতে পারব না। কিন্তু দুজন মানুষের জীবন চলে গেল, দুজন মানুষ মানে দুটো পরিবার। এর আগে কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার ঘটনা আমরা জানি। উত্তেজিত মুসল্লিরা সেবার ১৯টি পূজামণ্ডপে হামলা লুটপাট চালায়। ৭৫১টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন বন্ধ হয়ে যায়। এত বড়ো ঘটনায় অভিযুক্ত আসামী ইকবাল সম্প্রতি ছাড়া পেয়েছে। সে মানসিক ভারসাম্যহীন হোক আর না-হোক, নিশ্চিত তার পেছনে লোকজন আছে, সেই লোকজনদের আমরা কখনো চিনব না। সম্মিলিত জনতা কখনোই এসব ঘটনার পেছনের প্রকৃত আসামী চিনতে চায় না। কারণ এসব ঘটনায় সম্মিলিত জনতা খুশি হয় তাদের অবদমিত আকাঙ্খা পূরণ করতে পেরে।২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গণপিটুনিতে বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার মানে গড়ে বছরের প্রায় ১০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি চার দিনে একজন মারা যাচ্ছে। অধিকাংশ ডাকাত-ছিনতাইকারী-চোর সন্দেহে। কখনও ধর্ম অবমাননার গুজব, কখনও ‘কল্লাকাটা’, আবার কখনও ‘ছেলেধরা’। জনগণ জানে, চোর ছিনতাইকারী হলেও তাকে হত্যা করা যায় না। জেনেও করে। শুধু হত্যা না, সম্মিলিত জনতা নানা ধরনের উগ্র সহিংস ঘটনা ঘটায়। মতাদর্শিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা আরো ডেঞ্জারাস। তাই আমি মনে করি, অনেকে মিলে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারে না। বাবা বেঁচে থাকলে জোর দিয়ে বলতাম কথাটা। লেখক: কথাসাহিত্যিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়