মো. বিল্লাল হোসেন: সমাজকর্ম ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন করে নিজস্ব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী ও সামজিক ভুমিকা পালনে সক্ষম করে তোলে।
সমাজকর্ম অভিধানের ব্যাখ্যায়, “সমাজকর্ম হচ্ছে একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান যা মানুষকে মনোসামাজিক ভূমিকা পালনে একটি কার্যকর পর্যায়ে উপনীত হতে সাহায্য করে এবং সকল মানুষের কল্যাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থবহ সামজিক পরিবর্তন আনয়নে সাহায্য করে থাকে।”
পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলির প্রত্যক্ষ সুপারিশের মাধ্যমে ষাটের দশকে অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও সমাজকর্ম পেশার বিকাশ ঘটে। সমাজকর্ম হচ্ছে বিশেষায়িত পেশা।সমাজকর্ম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও মানুষের মধ্যকার সুষ্ঠু সমন্বয় সাধন করে। সমাজের সনাতনী চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োগ করে মানুষের চিন্তাভাবনাতে পরিবর্তন আনে সমাজকর্ম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সঠিক পরিচর্যা ও ভিত্তি গঠিত হয় সমাজকর্মীর মাধ্যমে। সমাজের বিশেষ লক্ষ্য পূরণ ও চিহ্নিত সমস্যা সমাধান করে একটি আদর্শ সমাজ বা সম্প্রদায় গঠন করাই হচ্ছে সমাজকর্মের মুখ্য উদ্দেশ্য।
একটি দেশের যথাযথ উন্নতির লক্ষণ দৃশ্যমান হয় স্থানীয় সমাজের উন্নয়নের মাধ্যমে। সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষার মান উন্নয়ন, মানবিক সম্পর্ক ত্বরান্বিতকরণ, মানবাধিকার চাহিদা পূরণ প্রভৃতি বিষয় দেশের স্থায়ী কাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দেশের আলাদা দৃষ্টান্ত তৈরি করে। উন্নত বিশ্বে এ কাজগুলো সম্পাদন করে একজন পেশাদার সমাজকর্মী। যার জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সামাজিক সমস্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যে, দেশগুলোর অপরাধ প্রতিনিয়ত কমছে। এতে ওই দেশগুলোর পুনর্বাসন কেন্দ্র, অপরাধ নির্মূল কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ওই দেশগুলোর এ অবস্থানে নিয়ে আসার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে পেশাদার সমাজকর্মীরা।
আমাদের দেশে পেশাদার সমাজকর্মীদের স্বীকৃতিহীনতার কারণে সমাজকর্ম পূর্ণমাত্রা পাচ্ছে না। একজন দক্ষ সমাজকর্মী সমাজের বিশেষ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও কাজ করে। তাছাড়া একজন বৈজ্ঞানিক গবেষণা নির্ভর সমাজকর্মী সমাজের প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যা ও মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা নিয়েও কাজ করতে পারবে। এতে আমাদের মানুষের আর্থসামাজিক জীবনযাত্রার মান পরিশীলিত হবে। তাছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সময় আসন্ন। ইতোমধ্যে সরকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি নিতে বলেছে সবাইকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০৪১ অর্জনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে পেশাদার সমাজকর্মীরা।
কিন্তু আমাদের দেশে সমাজকর্মের প্রচলনের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি এখনও মেলেনি। পেশার মানদন্ড ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে বাংলাদেশে সমাজকর্মের পেশাগত মর্যাদার ক্ষেত্রে সমাজকর্মের নিজস্ব জ্ঞান ভান্ডার রয়েছে। সমাজকর্মের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে কোন লোক নিজেকে পেশাদার সমাজকর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সমাজকর্মের যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। বাংলাদেশে জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম হিসেবে সমাজকর্মে স্বীকৃত। সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়িত সমাজসেবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীর জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতাজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যাবলী মোকাবেলা করার জন্য সমাজকর্মের কৌশল, শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যা বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার জনকল্যাণমুখিতার পরিচায়ক। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজও নির্ধারিত হয়নি সমাজকর্মের পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড। সমাজকর্মের কার্যকর পেশাগত সংগঠন না থাকায় পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের নিজস্ব আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পেশাগত মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদন্ড গড়ে উঠেনি। পেশাগত সংগঠন যে কোন পেশার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে সমাজকর্মে পেশায় নিয়োজিতদের অদ্যাবধি কোন পেশাগত সংগঠন গড়ে উঠেনি।
তবে বিভিন্ন সময়ে পেশাগত সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। যেমন ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে সমাজকর্ম পেশার মান উন্নয়ন ও সমাজকর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ‘‘বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকর্মী সমিতি’’ গঠন করা হয়। তবে এটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৬ সালে “বাংলাদেশ সমাজকর্ম শিক্ষক সমিতি” নামে একটি পেশাগত সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হলেও এখন এর কার্যক্রম নেই। বাংলাদেশে সমাজকর্মের জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারে কাউন্সিল অন সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (CSWE) এর আদলে ২০০৭ সালে বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন (BCSWE) গঠন করা হয়েছে। BCSWE বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষা ও অনুশীলনের মানোন্নয়ন ও পেশাগত স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে NASW, IASSW এবং APASWE এর মতো আন্তর্জাতিক পেশাগত সংগঠনসমূহের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত কর্মশালা ও জার্নাল প্রকাশ করছে, যা বাংলাদেশে সমাজকর্মের জ্ঞান বিকাশে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বায়নের যুগে আমাদের দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নানা আর্থ-সামাজিক সমস্যা যেমন- আত্মহত্যা, বিবাহ বিচ্ছেদ, শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের সমস্যা, প্রবীণদের নিরাপত্তাহীনতা, অপরাধ প্রবণতাসহ ইত্যাদি। এসব আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানে সমাজকর্মের জ্ঞান ও দক্ষতা খুবই কার্যকরী।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও পেশাদার সমাজকর্মী নিয়োগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
বর্তমানে দেশের পাঁচটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের প্রায় ১৫০০টি কলেজে সমাজকর্ম শিক্ষা চালু রয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও সমাজকর্ম ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে চালু আছে। বাংলাদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার সম্ভাবনার সাথে সমাজকর্মের পেশাগত সংগঠনের স্বক্রিয় তৎপরতা ও পেশাগত স্বীকৃতির বিষয়টি বিশেষভাবে জড়িত। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও তৎপরতার অদূর ভবিষ্যতে সমাজকর্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলে এদেশে সমাজকর্ম শিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
বর্তমান বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এক আধুনিক বিশ্ব। সমাজ ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি এনেছে এক অভাবনীয় পরিবর্তন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ হওয়ার পথে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য চারটি ভিত্তির মধ্যে "স্মার্ট সোসাইটি" ধারণাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজকে স্মার্ট সমাজ হিসেবে গঠন করতে হলে অবশ্যই সেই সমাজের সামাজিক সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাগুলো প্রথমেই খুঁজে বের করতে হবে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমস্যাগুলো বেড়ে চলেছে। সমাজে বিদ্যমান এসকল সমস্যার সমাধান না করে "স্মার্ট সোসাইটির" স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তবে এ সকল সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন পেশাদার সমাজকর্মী। একজন দক্ষ সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করতে হলে প্রথমত প্রয়োজন বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। আর সমাজকর্ম হলো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রায়োগিক বিষয়। এছাড়াও এটি আন্তর্জাতিক তথা উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে একটি সমাদৃত বিষয়।
প্রতিবছর মার্চ মাসের তৃতীয় মঙ্গলবার বিশ্বব্যাপী সমাজকর্ম দিবস পালিত হয়। সে অনুযায়ী প্রতি বছরের ন্যায় বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে এবছর বাংলাদেশও Shared Future for Transformative Change শ্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস পালিত হতে যাচ্ছে ১৯ই মার্চ। উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছর সরকারি, বেসরকারি পর্যায় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পালন করা হয় বিশ্ব সমাজকর্ম দিবস। তবে আমাদের দেশে সমাজকর্ম বিষয় চালুর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সমাজকর্মের পেশাগত স্বীকৃতি মেলেনি। তাই স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘স্মার্ট সোসাইটি’ গঠনে উন্নত বিশ্বের ন্যায় আমাদের দেশেও সমাজকর্ম কে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করি।
পেশা হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে চারটি স্তম্ভ তার মধ্যে অন্যতম ‘স্মার্ট সোসাইটি’ ধারণাটি পূর্ণতা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
মোঃ বিল্লাল হোসেন: সহকারী অ্যধাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজকর্ম বিভাগ, বাংলাবাজার ফাতেমা খানম কলেজ, ভোলা। ইমেইল: sun.bhola.bd@gmail.com