শিরোনাম
◈ বৃটেনে বাংলাদেশি প্রভাবশালীদের সম্পত্তি লেনদেন নিয়ে গার্ডিয়ানের বিস্ফোরক প্রতিবেদন ◈ জামায়াতের সমাবেশে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের বার্তা ◈ এনসিপির নিবন্ধনে ঘাটতি: ৩ আগস্টের মধ্যে সংশোধনের সময় দিয়েছে ইসি ◈ ট্রাম্পের ক্ষোভে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, মামলা ১০ বিলিয়ন ডলারের ◈ নারী সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপে শ্রীলঙ্কাকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শিরোপার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ ◈ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনা: ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষণ ও ভূ-রাজনৈতিক উদ্বেগ ◈ রাজধানীর পল্লবীতে বাসে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা ◈ ব্রহ্মপুত্রে চীনের দৈত্যাকার বাঁধ: ভারত ও বাংলাদেশের উদ্বেগ উপেক্ষা করেই প্রকল্পের উদ্বোধন ◈ জাতীয় মানবাধিকারের নামে সমকামিতার অফিস করতে দিবো না: মামুনুল হক ◈ মির্জা ফখরুলের ভাইয়ের ওপর হামলার প্রধান আসামি গ্রেফতার

প্রকাশিত : ১৯ জুলাই, ২০২৫, ১০:১৭ দুপুর
আপডেট : ২০ জুলাই, ২০২৫, ০৩:০২ রাত

প্রতিবেদক : এল আর বাদল

জুলাই যোদ্ধা নারীরা নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি

এল আর বাদল : বাংলাদেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নারীরা গৌরবময় ভূমিকা রেখেছেন৷ তারা রাজপথে লড়াই করেছেন৷ মিছিলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, জীবন দিয়েছেন৷ কিন্তু সেই নারীরা যে বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে৷

অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই শহিদ হিসাবে যে ৮৪৪ জনের নাম গেজেটভুক্ত করেছে তাদের মধ্যে ১০ জন নারী৷ আর ওই ১০ জনের মধ্যে চারজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে৷ জুলাই অভ্যুত্থানে যেসব নারী সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা এখন নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছেন৷ তাদের ঘরে আটকে রাখতে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ তাদের৷ নারীর প্রতি সহিংসতা, অবমাননা বেড়েই চলেছে৷ ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে নারীই উল্টো আসামি হচ্ছেন৷ নারীর অবমাননাকারীদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হচ্ছে৷ --- ড‌য়ে‌চে‌ভে‌লে

জুলাই যোদ্ধা নারীরা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন৷ তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে৷ জুলাই নারী যোদ্ধাদের অভিযোগ, ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের সহযোদ্ধারা এখন অশুভ শক্তি, উগ্রবাদীদের সঙ্গে আপোস করছে৷

সরকারে জুলাই আন্দোলনের তিন তরুণ জায়গা পেলেও আন্দোলনে অংশ নেয়া তরুণিদের কোনো জায়গা হয়নি৷  ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে একটিতেই নারীরা আছেন৷ আরো দুই একটি কমিশনে এক-দুইজন নারী থাকলে নেতৃত্ব পুরুষদের দখলে৷ আর জাতীয় ঐকমত্য কশিমনে একজন মাত্র নারী সদস্য৷

জুলাই আন্দোলনের নারীদের কথা ------

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী তিলোত্তমা ইতি৷ তিনি গত বছরের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘‘১৬ জুলাই ইডেন কলেজ থেকে সবচেয়ে বড় মিছিলটি বের করেছিলাম আমরা৷ তারপর পুলিশের হামলা, ছাত্রলীগের হামলা কোনো কিছুই পরোয়া করিনি৷ আমাদের এই আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচারের পতন হয়৷ আর এখন সেই আমিই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানির শিকার হচ্ছি৷

তিনি জানান, ‘‘জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাসের প্রতিবাদে আমি একটি পোস্ট দিয়েছিলাম ফেসবুকে৷ তারপর থেকেই একটি গোষ্ঠী আমাকে হেয় করছে৷ আমি কোনো পোস্ট দিলেই দল বেঁধে অনেক খারাপ মন্তব্য করছে৷ তারা চায় আমি যাতে আমার মতামত প্রকাশ না করি৷ তারা আমার চরিত্র হননে নেমেছে৷ এই পরিস্থিতির শিকার আরো অনেকে৷ আমরা যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম সেটা তো দূর হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখছি না৷ উল্টো নারীরা আরো বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ একটি গোষ্ঠী তাদের মতো করে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে৷’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘গত মার্চে শাহবাগে আমরা যারা ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন করেছি৷ তারা সবাই তার আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও ছিলাম৷ কিন্তু ওই(ধর্ষণবিরোধী) আন্দোলনের কারণে আমাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ একজন নারীকে তো ব্যাপক ট্রোল করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়৷ তার পরিবারকে নানাভাবে চাপে ফেলা হয়৷

এই ঘটনার প্রত্যক্ষ শিকার আদ্রিতা রায়৷ তিনি জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন৷ তিনি তখন উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী৷ এখন তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন৷  আদ্রিতা বলেন, ‘‘মার্চে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হামলার শিকার হই৷ মামলা হয় আমাদের বিরুদ্ধে৷ আমি তিন নাম্বার আসমি৷ শুধু তাই নয় আমার ছবি দিয়ে, আমার পরিবারের সদস্যদের ছবি দিয়ে নানা অপপ্রচার করা হয়, বডি শেমিং করা হয়৷ ছবি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়৷ তখন আমি বাইরে বের হতে পারতাম না৷ মাস্ক পরে বের হতে হতো৷ বাইরে কোথাও যেতে হলে মা সাথে যেতেন৷ আমি আর আমার পরিবার নিরপত্তাহীনতার মধ্যে পড়ে যাই৷ জুলাই আন্দোলনের পর ওটা ছিলো আমার জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়৷’’

তিনি আরও বলেন,‘‘আসলে আমরা একটা বৈষম্যহীন সমাজের জন্য মাঠে নেমেছিলাম৷ কিন্তু সেটা এখন ফিকে হয়ে গেছে৷ অন্তর্বর্তী সরকার তেমন কিছুই করছে না৷ হেফাজত সমাবেশ ডেকে নারী কমিশনের সদস্যদের অশ্লীল ভাষায় গালি দিল, নারীদের অপমান করল, কিন্তু সরকার কোনো ব্যবস্থা নিলোনা তাদের বিরুদ্ধে৷ আর যাদের সাথে একসঙ্গে আন্দোলন করেছি তারা নতুন দল গঠন করল এনসিপি৷ সেই দলের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ হেফাজতের ওই সমাবেশে গিয়ে বক্তৃতা দিলেন৷ ফলে তাদের ওপরও আশা করার কিছু নাই৷

ফুলের মালা কার গলায়? ---

২৮শে মে বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এলাকায় নারীকে লাথি মারা আকাশ চৌধুরী আটক হলেও জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়৷ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস ও মুক্তির প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আন্দোলনকারী এক নারীকে লাথি মারে সে৷ সে ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগরের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা৷ সমালোচনার পর অবশ্য তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে৷

গত মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক নারীকে তার পোশাক নিয়ে হেনস্তা করার পর ভুক্তভোগী নারী শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে ওই মামলায় আটকের পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও তৌহিদী জনতা থানা ঘেরাও করে৷ থানা থেকে আদালতে পাঠানোর পর তিনি জামিন পান৷ তার মুক্তির পর পাগড়ি, ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়, ওই নারী মামলা প্রত্যাহারেও বাধ্য হন৷ এরপর ধর্ষণের শিকার নারীকে মারধর ও বিবস্ত্র করে ভিডিও করা এবং তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে কুমিল্লায় ২৬ জুন৷

গত মে মাসে ঢাকার লালমাটিয়ায় একটি চায়ের দোকানে দুই তরুণী ধূমপান করায় কথাকাটির পর তাদের মবের মুখে পড়তে হয়৷ পরে পুলিশ ওই দুই তরুণিকে থানার হেফাজতে নিয়ে যায়৷ তারপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘পাবলিক প্লেসে ধূমপান নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য অপরাধ৷ কেউ যেন ওপেন প্লেসে ধূমপান না করেন৷

নারীদের ঢাল বানানো হয় -----

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থী অর্ণি আনজুম বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হলের শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করাদের একজন৷ ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ যে হামলা করে তিনি সেখানে হামলার শিকার হন৷ তার মধ্যেও এখন হতাশা কাজ করছে৷

তিনি বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলণের সময় আমরা নারীরাই সামনে ছিলাম৷ আসলে নারীদের আন্দোলনের সময় সামনে দেয়া হয়৷ আসলে আমাদের ঢাল হিসাবে সামনে দেয়া হয়েছে৷ অনেক নারী আন্দোলনে ছিলেন একটি বৈষম্যহীন সমাজের আকাঙ্ক্ষায় আর নারীরা যখন নেমে আসে তখন স্বৈরাচার টিকতে পারে না৷ কিন্তু দেখা গেলো স্বৈরাচারের পতনের পরও নারীদের বিভিন্ন জায়গায় টোকেন হিসাবে রাখা হয়েছে৷ সবখানেই ব্যাটাগিরি দেখানো হয়েছে৷ তরুণদের যে দল হলো সেখানেও নারীদের টোকেন হিসাবে রাখা হয়েছে৷ আসলে কিছুই বদলায়নি৷ নারীরা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে৷  তাদের ঘরের মধ্যে ঢোকানোর জন্য অপশক্তি আরো সক্রিয় হচ্ছে৷ নারীর এখন পোশাকে দোষ, চলনে দোষ, বলনে দোষ৷ শাহবাগে যখন আমরা নারীর নিরাপত্তা চাইলাম তখন আর্মি , পুলিশ  নিরাপত্তা দিলো না৷ যৌক্তিক আন্দোলনে তারা সাড়া দেয় না৷ কিন্তু গোপালগঞ্জে গিয়ে ইন্টেরিমের পুলিশ, আর্মি ঠিকই গুলি করলো৷

নারীর অবস্থান কী? ----

জুলাই গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া নারী ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নাফিজা জান্নাত বলেন, ‘‘ আমরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ বিপুলভাবে নারীরা জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল৷ আমরা পরিবর্তন চাইছি৷ কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি৷ একই আছে৷ ফলে বৈষম্য আগের জায়গায়ই আছে৷''

জুলাই আন্দোনে অংশ নেয়া নারীদের কেউ কেউ নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যোগ দিয়েছেন৷ তাদের একজন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন মনে করেন, ‘‘নারীরা এখানো নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন৷ নানা ধরনের ট্রোলের শিকার হচ্ছেন৷ আমাদের দলের নারীরাও নানা ধরনের ট্রোলের শিকার হচ্ছেন৷ আমাদের একজনের ছবি বিকৃত করে তো নানা ভাবে অপপ্রচার হচ্ছে৷ এখানে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন দরকার৷ এনসিপি সেটা চেষ্টা করছে৷ আমরা চাই নারীদের জন্য সংসদের আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচন হোক৷''

একই দলের আরেকজন যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনুভা জাবীন বলেন, ‘‘নারীকে দমিয়ে রাখতেই তাকে নিয়ে ট্রোল করা হয়৷ নানা ধরনের অপবাদ দেয়া হয়, অপপ্রচার করা হয়৷ এটা করা হলে তার পরিবার তাকে আটকে দেয়৷ জুলাই আন্দোলনের অনেক নারী তাই হেনস্তার শিকার৷

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলনে যেভাবে মেয়েরা অংশ নিয়েছে সেভাবে তারা মর্যাদা পায়নি৷ এতগুলো সংস্কার কশিশন হলো তার মাত্র একটির চেয়ারম্যান নারী৷ আবার তারা( আন্দোলকারী তরুণরা) যে দল গঠন করেছে সেখানেও নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে, প্রতিকার পাচ্ছে না৷ নারী বিদ্বেষী মনোভাব সব সময়ই ছিলো, কিন্তু এখন সেটা আরো উগ্রভাবে প্রকাশ পাচ্ছে৷ আর তারা যে দল গঠন করেছে সেই দলের মেয়েরাও এখন বলছে নারীর প্রতি বৈষম্যের কথা, নারীর প্রতি নানা আনাকাঙ্খিত আচরণের কথা৷''

মানবাধিকার কর্মী নূর খানের পর্যবেক্ষণ হলো জুলাই আন্দোনে নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো বহুমাত্রিক৷ সবখান থেকে নারীরা এক যোগে হাতে হাত মিলিয়ে রাস্তায় নেমেছিলো৷ কিন্তু সেই অবস্থান এখন আর দেখছেন না তিনি৷ নারীদের অংশগ্রহণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আগের মতই কম বলে জানান তিনি৷ উল্টো এখন নারীবিরোধী একটি অপশক্তির আস্ফালন দেখছেন নূর খান৷৷

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়