বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনে একটি অধ্যাদেশ জারির পর দেশে এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মঙ্গলবার মধ্যরাতে অধ্যাদেশ জারির পর কোনও কোনও গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে নতুন এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে। তবে সরকার সেই বক্তব্য অস্বীকার করেছে।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন স্বাক্ষরিত সংশোধিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অধ্যাদেশে, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এর সহযোগীর সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
সংশোধিত অধ্যাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার এবং উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনীকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, অন্যান্যদের সাথে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলা হয়েছে, মুজিবনগর সরকারের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্স বা অন্যান্য সহকারীদের এই তালিকায় রাখা হয়েছে।
মূলত নতুন অধ্যাদেশে এই বিষয়টি যুক্ত করার কারণে কোনও কোনও গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়, শেখ মুজিবসহ চার শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে।
এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরির পর বিষয়টি নিয়ে বিবিসি বাংলা কথা বলেছে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমের সাথে।
উপদেষ্টা মি. আজম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, "শেখ মুজিবুর রহমান ও চার নেতাকে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রাখা হয়েছে। তারা তো থাকবেনই। তাদের কেন বাদ দেয়া হবে? মুক্তিযুদ্ধটাতো পরিচালনা করেছেনই তারা"।
তিনি জানান, 'মুজিবনগর সরকারে যারা ছিলেন, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। যারা সশস্ত্রভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, যারা পরিচালনা করেছে, তারা মুক্তিযোদ্ধা। তবে ওই সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীরা হবে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা।
নতুন অধ্যাদেশে আগের আইনের ১০টি ধারায় বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়েছে। সংশোধিত অধ্যাদেশের আরো কিছু সংজ্ঞায়ও আনা হয়েছে পরিবর্তন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কারা?
গত ১৫ই মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরে মঙ্গলবার রাতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
অধ্যাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংজ্ঞায় বলা হয়েছে , "যাহারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামে-গঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করিয়া ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এরূপ সকল বেসামরিক নাগরিক উক্ত সময়ে যাদের বয়স সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে; এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর), পুলিশ বাহিনী, মুক্তি বাহিনী, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (মুজিবনগর সরকার) ও উক্ত সরকার কর্তৃক স্বীকৃত অন্যান্য বাহিনী, নৌ কমান্ডো, কিলো ফোর্স, আনসার সদস্য এবং বাংলাদেশের নিম্নবর্ণিত নাগরিকগণও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হইবেন।"
এছাড়াও সংশোধিত সংজ্ঞা অনুযায়ী- হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী কর্তৃক নির্যাতিত নারী বা বীরাঙ্গনারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন।
আর, মুক্তিযুদ্ধকালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী ফিল্ড হাসপাতালের সকল ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসা-সহকারীরাও থাকবেন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধে আহত কিংবা শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা স্বীকৃতি মিলবে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
যে সব বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ চলাকালে নিহত হয়েছেন সংজ্ঞা অনুযায়ী তাদেরকে বলা হবে 'শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা''।
সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা কারা?
সংশোধিত এই মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইনে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি সহযোগী মুক্তিযোদ্ধারও সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, "যাহারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা প্রবাসে অবস্থান করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে সংগঠকের ভূমিকা পালন, বিশ্বজনমত গঠন, কূটনৈতিক সমর্থন অর্জন এবং মনস্তাত্ত্বিক শক্তি অর্জনের প্রেক্ষাপটে যেসব বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করিয়াছেন।"
এরপরই এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে- ক) যেসব বাংলাদেশি পেশাজীবী মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশে অবস্থানকালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিলেন এবং যেসব বাংলাদেশি নাগরিক বিশ্বজনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন;
খ) যেসব ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা দূত এবং ওই সরকারের নিয়োগ করা চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন;
গ) মুক্তিযুদ্ধকালীন গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের (মুজিবনগর সরকার) সঙ্গে সম্পৃক্ত সব এমএনএ বা এমপিএ; এবং যারা পরে গণপরিষদের সদস্য গণ্য হয়েছিলেন;
ঘ) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী ও কলাকুশলী এবং দেশ ও বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে দায়িত্ব পালনকারী সব বাংলাদেশি সাংবাদিক
ঙ) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
অর্থাৎ এই পাঁচটি ক্যাটাগরিতে যারা ছিলেন তাদের স্বীকৃতি দেয়া হবে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
সংজ্ঞা অনুযায়ী সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যারা গণ্য হবেন তাদের স্বামী বা স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা ও মাতা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
বিতর্ক কী? যা বলছে সরকার
মঙ্গলবার রাতে সংশোধিত অধ্যাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার নিয়ে সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে।
এই সংজ্ঞায় অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' হিসেবে বিবেচিত হবেন। অন্যদিকে মুজিবনগর সরকার গঠনে যারা সহযোগিতা করেছেন, তাঁরা হবেন 'মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী'।
মূলত এই বিষয়টি নিয়েই এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়। কেননা এই অধ্যাদেশ নিয়ে কোনও কোনও গণমাধ্যমের রিপোর্টে দাবি করা হয়, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের (মুজিবনগর সরকার) রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক রাজনীতিবিদের (এমএনএ-এমপিএ) মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল করা হয়েছে।
সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে এই রিপোর্ট প্রকাশের পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নানা বিতর্ক দেখা যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনাও করেন অনেকে।
যদিও অধ্যাদেশে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে (মুজিবনগর সরকার) বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় রাখা হয়েছে। তবে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সংসদের যে সদস্যরা ছিলেন, তারা সবাই এখন থেকে মুক্তিযোদ্ধার বদলে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পাবেন।
কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে কী বাদ দেয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে?
এই প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ইতিহাস কেউ কী কেউ মুছতে পারে না। জাতীয় চার নেতা ও শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই থাকবে, আছে। তাদেরকে বাদ দেয়া হয়নি। বাদ দেয়ার কোন কারণও নেই"।
তিনি অভিযোগ করেন, নতুন অধ্যাদেশ জারির পর এই বিষয়টি নিয়ে না বুঝেই ভুল ব্যাখ্যা ও বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে।
বুধবার দুপুরে এ নিয়ে ব্যাখ্যা দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরও। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং দুই মন্ত্রী মো. মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ শতাধিক নেতার মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিল বলে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা ঠিক নয়।