এল আর বাদল: অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো মতপার্থক্য বা বিভেদ নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সোমবার সেনা সদরের একটি সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে করিডর ইস্যু, কুকি-চিন, পুশইন, সেনাপ্রধানের বক্তব্যসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে।
সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, "যেভাবে বলা হচ্ছে, সরকারের সাথে সেনাবাহিনীর বিশাল মতপার্থক্য হয়েছে, বিভেদ হয়েছে। যেটা দেখছি মিডিয়াতে...এরকম আসলে কিছু হয়নি। সরকার এবং সেনাবাহিনী খুব সুন্দরভাবে একে অপরের সহযোগিতায় কাজ করছে। সুতরাং এটা নিয়ে মিস ইন্টারপ্রেট (ভুলভাবে ব্যাখ্যা) করার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, "আমরা যেন এটাকে এমনভাবে না দেখি যে, সরকার এবং সেনাবাহিনী ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা করছে বা একে অপরের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কখনোই নয়। সরকার সেনাবাহিনী একই সাথে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতে আরও সুন্দরভাবে কাজ করে যাবো বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। -- সূত্র, বিবিসি বাংলা
সরকারের নির্দেশনা মেনেই বাহিনীর সদস্যরা দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন ।
-- সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী যা বলছে --
এদিন সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের নানা প্রশ্নের জবাব দেন সেনা সদরের মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ নাজিম-উদ-দৌলা। এর আগে সেনাবাহিনীর নানা অর্জন নিয়ে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের কর্নেল স্টাফ, মো. শফিকুল ইসলাম।
সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সম্পর্কের বিষয়ে করা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, "আমি মনে করি না এই বিষয়টি এমন কোনো পর্যায়ে গেছে যা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করছে। প্রতিনিয়তই আমরা সরকারের সঙ্গে নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি"।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সম্প্রতি পুশ-ইন ইস্যুতেও কথা বলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ নাজিম-উদ-দৌলা।
তিনি বলেন, "পুশ-ইন আমরা লক্ষ্য করছি। এটা কোনও ভাবেই কাম্য নয়। এমনটা হতে থাকবে আর আমরা বসে থাকবো এটা ভাবারও কোনও কারণ নেই। বিজিবি এটা নিয়ে নিয়ম অনুযায়ী কাজ করছে এবং সরকারও এ বিষয়ে অবগত। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন আছে এমনটা মনে হলে সরকারের নির্দেশে অবশ্যই সেনাবাহিনী সেটাতে যাবে।
লালমনিরহাট বিমান বন্দর চীন ব্যবহার করতে পারে কিনা গণমাধ্যম কর্মীদের এমন প্রশ্নের উত্তরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, "লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি অনেক পুরনো। এটা আগেও ছিল কিন্তু ব্যবহার হয়নি। প্রয়োজন বলেই সেটাকে আবারো সচল করা হচ্ছে। তবে, চীন এই বিমানবন্দর ব্যবহার করবে কিনা সে বিষয়ে এখনও কোনো তথ্য নেই"।
তিনি বলেন, "দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোন কর্মকাণ্ড কিংবা কোনো দেশকে অনুমতি দেয়ার বিষয়ে সরকার ভেবে পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু আমি মনে করি না, সরকার চিন্তা না করে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠির দ্বারা দেশের সীমান্ত এলাকা ঝুঁকিতে রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, "আমরা অবশ্যই বর্ডার কম্প্রোমাইজ করিনি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি থাকবে আমরা কোনও ছাড় দেব না, এটা আমাদের দেশ এবং যেকোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা রক্ষা করবো"।
আরসার বাংলাদেশে আসা এবং অবস্থান করার বিষয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থানও জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার এখন খুবই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্য প্রায় দখলে নিয়েছে, যাতে মিয়ানমার সরকারের অস্তিত্ব এখানে বিলিনের পথে। আরাকার আর্মিও কোন স্বীকৃত সংগঠন নয়।
তিনি বলেন, "এই মুহূর্তে মিয়ানমারের এই অংশের পরিস্থিতি যেকোন সময়ের তুলনায় সংবেদনশীল। সেক্ষেত্রে এখানে কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠির চলাচল অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটাকে আমরা পদক্ষেপ নেব না, বিজিবিসহ আমরা সীমান্তে নজর রাখছি।
সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর অর্জন নিয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কর্নেল মোঃ শফিকুল ইসলাম। এরপরে তিনি আলোচিত কয়েকটি ইস্যুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।
মানবিক করিডর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতপার্থক্য হচ্ছে, রাজনৈতিক অঙ্গন ও সামাজিক মাধ্যমে এমন আলােচনা চলছে কয়েকদিন ধরে।
এর আগে গত ২১শে মে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মানবিক করিডর, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কথা বলেছেন বলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
সেসব খবরে বলা হয়েছে, সেনাপ্রধান বলেছিলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা হতে হবে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার করিডর ইস্যুতে সেনাবাহিনী কী ভাবছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জাবাবে কর্নেল মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, "করিডর একটি স্পর্শকাতর বিষয়। দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোন কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না"।
আরাকান আর্মি বাংলাদেশে ঢুকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে, এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শফিকুল বলেন, "আরাকান আর্মির সঙ্গে আমাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। গণমাধ্যমে যতটুকু আপনারা দেখেছেন তার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে"।
অফিসার্স অ্যাড্রেস ইস্যুতে সেনাপ্রধানের যেসব বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কর্নেল শফিকুল বলেন, "এটি সেনাবাহিনী প্রধানের নিয়মিত কার্যক্রমেরই ধারাবাহিকতা। যেখানে কোনো গণমাধ্যমকে ডাকা হয়নি কিংবা আন্তবাহিনী গণসংযোগ পরিদপ্তরও আনুষ্ঠানিক কোন বিবৃতি দেয়নি। যেটা গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে এসেছে তার সঠিকতা বা বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে।
নির্বাচনের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কোন অবস্থান আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শফিকুল বলেন, "নির্বাচনের বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে, এ নিয়ে এখন আমরা আর কোনো কথা কথা বলতে চাচ্ছি না। সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়া ইচ্ছা বা এধরণের কোনো আলোচনাও আমাদের মধ্যে হয়নি"।
করিডর, বন্দর ইস্যুতে দেশের সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তৈরী হতে পারে এই বিষয়গুলো সেনাবাহিনী আমলে নিচ্ছে কিনা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেনাবাহিনী সব সময় একতাবদ্ধ হয়েই কাজ করছে, ভবিষ্যতেও তাই হবে।
জাতিয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোনো কাজে সেনাবাহিনী সম্পৃক্ত হবে না বলে আবারো পূণর্ব্যাক্ত করেন কর্নেল শফিকুল।
কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) কার্যক্রম ও সামাজিক মাধ্যমে দেশের কারখানায় তাদের পোশাক তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল শফিকুল বলেন, "সামাজিক মাধ্যম বা যেকোন মিডিয়াতে আসা তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ব্যোম জনগোষ্ঠির মোট সদস্যই ১২ হাজার সেখানে ৩০ হাজার পোশাক বা ইউনিফর্মের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
যদিও আরেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা কুকি চীন ইস্যুতে বলেন, "গণমাধ্যমে আসা কারখানার ছবিসহ সংবাদটির বস্তুনিষ্ঠতা অবশ্যই রয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠিটির উত্থান উদ্বেগের। তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে" বলেও জানান তিনি।
এছাড়া গণমাধ্যমে তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে কোন বিবৃতি দেয়া হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শফিকুল বলেন, এখন থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রতিটি বিষয়ে সেনাবাহিনী গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন তথ্য জানাবে।