বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ইস্যুতে তৃতীয় যেকোন দেশে পাঠাতে পারে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর)। সেই হিসেবে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও ২০১৭ সাল থেকে সেই প্রক্রিয়া শুরু করে সংস্থাটি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ১০ দেশে ৪ হাজার ৬২৩ জন রোহিঙ্গাকে পাঠিয়েছে তারা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঠানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়।
মূলত বাংলাদেশ সরকার একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও পরাশক্তির দেশগুলোর সমর্থন না পাওয়ায় আলোর মুখ দেখেনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। তবে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টার পাশাপাশি তৃতীয় দেশে পুর্নবাসনের উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ।
বাংলাদেশ সরকারের কয়েকটি দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গত ৮ বছরে মোট ১০ দেশে রোহিঙ্গাদের পাঠিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা গত ৮ বছরে নিয়েছে ২ হাজার ৩৭০ জনকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোহিঙ্গা নিয়েছে কানাডা। দেশটি নিয়েছে ১ হাজার ৪৩২ জন রোহিঙ্গা। অস্ট্রেলিয়া সরকারও রোহিঙ্গাদের নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ তৎপর ছিলো। তারা নিয়েছে ৬৬২ জনকে। এছাড়াও নেদারল্যান্ডে ৭ জন, সুইডেন ৩ জন, ইতালি ৪ জন, যুক্তরাজ্য ৫ জন, আয়ারল্যান্ড ৩ জন, নিউজিল্যান্ড ১৫৪ জন, গ্রিস ৩ জন ও জাপানে পাঠানো হয়েছে ৩ জন রোহিঙ্গাকে।
মিয়ানমারে শতবছর ধরে নাগরিকত্বের অধিকার এবং মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গাদের জন্য তৃতীয় দেশে পুর্নবাসন নিরাপদ সমাধান হলেও এই প্রক্রিয়া বন্ধের দাবি তুলেছে উখিয়া টেকনাফের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা। তারা বলছেন, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি উখিয়ার লম্বাশিয়া এবং এর আশপাশের ক্যাম্প ঘুরে কথা হয় বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে। যাদের সঙ্গে কথা হয় তাদের অনেকেই মিয়ানমারে পড়াশোনা করেছেন। এখন ক্যাম্পে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
তাদের মধ্যে একজন শাহনাজ বিবি। তিনি জানান, আমরা দুর্দশাগ্রস্থ জাতি। আমাদের মাথার ওপর কোন ছায়া নাই, যার কারণে শত বছর ধরে নিপীড়নের মধ্যে আছি। তিনি আরও জানান, আমাদের শেষ ভরসা শিক্ষিত রোহিঙ্গারা। তারা আওয়াজ তুললে বিশ্ববাসী শুনবে। কিন্তু তারাও পুর্নবাসনের নামে বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। ফলে আমাদের অধিকার আদায়ের মানুষ আর থাকছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে নিজের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাবে।
অনেকটা শাহনাজ বিবির সুরেই কথা বলেন মোহাম্মদ সাদেক, মোহাম্মদ হুমায়ুন, আরফাজ কামালসহ আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, প্রায় ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পে। সেখান থেকে ৮ বছরে নেয়া হয়েছে অল্পকিছু রোহিঙ্গা। যাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত। ফলে শিক্ষিত নেতৃত্ব শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া এই প্রক্রিয়ার প্রভাবে রোহিঙ্গারা নিজদেশ মিয়ানমার বিমুখ হয়ে পড়ছে। ফলে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শিক্ষিত নেতৃত্ব শূন্য হয়ে প্রত্যাবাসন অনিশ্চয়তায় পড়ে যাচ্ছে। তাদের দাবি, শিক্ষিত নেতৃত্ব ছাড়া নিজদেশে ফেরত যাওয়ার আওয়াজ তোলা সম্ভব নয়। তারা জানান, আমাদের বেশি জরুরি নিজের দেশ মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা দরকার।
তৃতীয় দেশে কখন পাঠানো হয়:
মূলত নিজদেশে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং যেখানে আশ্রয়ে আছেন সেখানে থাকা সম্ভব নয় এমন শরণার্থীদের তৃতীয় দেশে পুর্নবাসন প্রক্রিয়া সমন্বয় করে ইউএনএইচসিআর। এই প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি আছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনেরও। কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ শিক্ষিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে তৃতীয় দেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া নিজদেশে যাওয়ার বিষয়ে অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
এদিকে, রোহিঙ্গা সংকটে প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে। যার ফলে অনিশ্চয়তা দিনদিন বাড়ছে। উৎস: চ্যানেল২৪