ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে কাজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভাষাগত ও কারিগরি দক্ষতার অভাবে সম্ভাবনাময় এই শ্রমবাজার ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। ফলে ইউরোপে বাংলাদেশি কর্মী প্রেরণের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ইউরোপে কর্মী যাওয়ার সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, যা দেশের অভিবাসন খাতের জন্য একটি বড় দুঃসংবাদ।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের অবস্থান সংকুচিত হচ্ছে।
২০২৩ সাল: ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ৩০,৪২৭ জন বাংলাদেশি কর্মী গিয়েছিলেন।
২০২৪ সাল (চলতি বছর): এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৬,০৭৭ জনে।
মোট অভিবাসন: ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৯ জন কর্মী বিদেশে গেলেও তাদের মধ্যে ইউরোপে গেছেন মাত্র ১.৫৮ শতাংশ।
ইতালি, ফ্রান্স, রোমানিয়া, পর্তুগাল, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশিরা বৈধ ও অবৈধ উভয় পথেই পাড়ি জমান। কিন্তু দক্ষতার অভাবে বৈধ পথে যাওয়ার সুযোগ ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে।
১. দক্ষতা ও ভাষার ঘাটতি:
ইউরোপের দেশগুলো অদক্ষ কর্মীর পরিবর্তে নির্দিষ্ট কাজে পারদর্শী ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী চায়। পাশাপাশি, যোগাযোগের জন্য স্থানীয় ভাষা বা ইংরেজি জানা আবশ্যক। এই দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশি কর্মীরা পিছিয়ে রয়েছেন।
দক্ষ কর্মীর হার: ২০২৪ সালে বিদেশে যাওয়া মোট কর্মীর মাত্র ২৩.৬২ শতাংশ (২ লাখ ১৪ হাজার ৪৪ জন) দক্ষ ছিলেন। বিপরীতে, ৫৪.২৩ শতাংশই (৪ লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ জন) ছিলেন অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষ।
২. প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার দুর্বলতা:
সরকারিভাবে ১১০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকলেও সেগুলোর মান ও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ।
সফলতার হার: গত পাঁচ বছরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো থেকে ৪ লাখেরও বেশি কর্মী প্রশিক্ষণ নিলেও তাদের মাত্র ৮-১২ শতাংশ বিদেশে যেতে পেরেছেন। প্রায় ৭০ শতাংশই বেকারত্বের হতাশায় ভুগছেন।
মানের অভাব: প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের অভাব রয়েছে। ফলে এখানকার প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না।
৩. ইমেজ সংকট ও অবৈধ অভিবাসন:
অনেক কর্মী নন-শেনজেনভুক্ত কোনো দেশে বৈধভাবে প্রবেশ করে সেখান থেকে অবৈধভাবে শেনজেনভুক্ত দেশে চলে যান। এটি ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে, যা বৈধ অভিবাসনের পথে বড় বাধা।
৪. কূটনৈতিক উদ্যোগের অভাব:
ইউরোপের প্রায় ২৭টি দেশে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক চুক্তি রয়েছে। সম্প্রতি ইতালির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হলেও গ্রিস ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে কোনো চুক্তি নেই।
ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্টদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী জানান, "আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো শুধু সার্টিফিকেট দেয়, কিন্তু কর্মীর অভিজ্ঞতার নিশ্চয়তা দেয় না। ফলে নিয়োগকর্তারা এসে দক্ষতার প্রমাণ না পেয়ে তাদের ফিরিয়ে দেন।"
করণীয়:
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি:
১. প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন: আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষক ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
২. চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ: ইউরোপের শ্রমবাজারের চাহিদা বিশ্লেষণ করে সেই অনুযায়ী ট্রেড কোর্স (যেমন: ওয়েল্ডিং, ইলেক্ট্রিক্যাল, কেয়ারগিভিং, হসপিটালিটি) চালু করতে হবে।
৩. ভাষা শিক্ষা: প্রশিক্ষণের সঙ্গে ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা শেখাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি: ইউরোপের নতুন নতুন দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (MoU) সই করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে।
৫. সমন্বয়: রিক্রুটিং এজেন্সি এবং সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর (টিটিসি) মধ্যে একটি শক্তিশালী সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা সহজেই নিয়োগকর্তার কাছে পৌঁছাতে পারে।
ইউরোপের শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনা। সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে দক্ষতার ঘাটতি পূরণ করতে পারলেই এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে। উৎস: ফেয়ার নিউজ।