ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] আমাদেরসময় ডটকম ও আমাদের অর্থনীতি : তিন বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে আপনি অনেক প্রো-অ্যাক্টিভ ছিলেন। সক্রিয় দায়িত্ব পালনের অর্জন কী। কী কী করতে পারলেন এই সময়ে?
অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় : মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাসে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর থেকে ভাইস চ্যান্সেলরÑআজ পর্যন্ত, দুটো পদই পেয়েছি। আবার মহাসচিব থেকে কেউ ভিসি হননি, আমি বিএমএ’র মহাসচিব ও ভিসি হয়েছি। আমি এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ে যা কিছু নেই, তা প্রথমে করতে চেয়েছি। একটি ইমার্জেন্সি সেন্টার করেছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ বছরেও কোনো ইমার্জেন্সি ছিলো না। ইমার্জেন্সি চালুর পর প্রথম সফলতা হলো, অনেক রোগী গ্রাম থেকে আসেন, তারা অন্তত এক রাত থাকতে পারেন। স্ট্রোক করা রোগীরা হেঁটে বাড়ি যান, এটা অনেকেই জানেন না। কিছুদিন আগে আমাদের এখানে একজন রোগী এসেছিলেন স্ট্রোক করার তিন ঘণ্টার মধ্যে। আমাদের মেডিসিনের যে নিউরোলজিস্টরা আছেন, তারা তাকে ফিব্রিনোলাইটিক এজেন্ট ইনজেকশন দেন। সেই রোগী সাতদিন পর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে যান! স্ট্রোকের রোগী হেঁটে হেঁটে যানÑ এটা কখনো হয় না। তার মানে এটি ইমার্জেন্সির একটি সফলতা।
[৩] আমি বিএসএমএমইউ’র দায়িত্ব নেওয়ার পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছার নামকরণে একটি বিভাগ চালু করি, যেটি ৬ বছর বন্ধ ছিলো। আমরা সেটা যেমন চালু করেছি, তেমন চিকিৎসা সেবাও দিয়েছি। ৬ বছর পড়েছিলো একটি বিল্ডিং, কোনো কাজে ব্যবহার করা হয়নি এই সময়ে, সেখানে আমরা আন্তর্জাতিক মানের শেখ রাসেল হল বানিয়েছি। আমাদের যে মহিলা হোস্টেল ছিলো, সেটা ভেঙে-চুরে গিয়েছিলো, যেটা আমি পুনঃনির্মাণ করেছি। আমাদের যে ওপিডি আছে, এটার কাজ কতোদিনের মধ্যে দিতো তার কোনো ঠিক ছিলো না। কিন্তু আমি এসে ছয় মাসের মধ্যে কাজটা নিয়েছি। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তৈরি করেছি সি-ব্লকের সামনে এবং এখানে কোনো ফোয়ারা ছিলো না, আমরা তা তৈরি করি। বিএসএমএমইউতে পার্কিংয়ের জায়গা খুবই কম। কিন্তু গাড়ি অনেক বেশি। আমাদের ইচ্ছে ভবিষ্যতে বেতার ভবনের সামনে একটি মাল্টি পার্কিংয়ের জায়গা করবো, আর তা না করা পর্যন্ত দেখবোÑ জ্যামটা কতোটা কমিয়ে আনা যায়।
[৪] আমার আরও একটি ইচ্ছে আছে, সেটি হলোÑ একটি গেইট করবো। বিশ্বের সকল ইউনিভার্সিটির গেইট থাকে, যা আমাদের নেই। আপনাদের অবগতির জন্য জানাতে চাই যে, আমাদের রোগীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার রোগী বিএসএমএমইউ’র আউটডোরে আসেন। পদ্মা সেতু তৈরি হওয়ার পর আমাদের এক হাজার রোগী বেড়ে গেছে। এর বেশির ভাগই আসেন শরীয়তপুর, খুলনা, মাদারীপুর থেকে। তারা সকালে আসেন, পরীক্ষা করে অনলাইন রিপোর্ট দেখিয়ে আবার বিকালে চলে যান। আগে এই রোগীগুলো খুলনা, বরিশাল থেকে সাতক্ষীরা হয়ে যশোরে চলে যেতো, যেটা এখন আর যাচ্ছে না। ঢাকায় থেকে যেসব রোগীরা চিকিৎসা করতেন তাদের খরচও অনেক কমেছে। মেট্রোরেল পুরোপুলি চালু হতে যাচ্ছে। বিএসএমএমইউতে রোগীর চাপ বাড়বে। আমরা সেটা জানি। রোগীর চাপ মোকাবেলায় আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
[৫] বিএসএমএমইউতেই একমাত্র বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা আউটডোরে এসে চিকিৎসা দেন। আমরা আমাদের ম্যানপাওয়ার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আউটডোরের রুম বৃদ্ধির পরিকল্পনাও আছে। আমি কিছু আউটডোর বেতার ভবনেও নিয়ে যাবো। আপনারা জানেন আমাদের শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে। পাসের হারও বেড়েছে। বিশেষজ্ঞ তৈরিও বেড়েছে। যেহেতু দেশে মেডিকেল সংখ্যা ১১৩টি, সেজন্য এখন বেসিক সাবজেক্টের টিচার তৈরি করতে হবে আমাদেরই। আমরা সেদিকে নজর দিয়েছি। আগে গবেষণা খাতে ৪ কোটি টাকা বাজেট ছিলো, যা আমি আসার পর পেয়েছি। তার আগে ছিলো মোট ২ কোটি টাকা। এখন ৭৬৭ কোটি টাকা হয়েছে। আমি ৩২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা গবেষণার জন্য দিয়েছি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি তাঁর স্বপ্নের একটি হাসপাতাল। পদ্মা সেতু তৈরি করে তিনি যেমন আমাদের স্বপ্নপূরণ করেছেন, তেমনি স্বাস্থ্য বিভাগে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি তাঁর একটি স্বপ্ন, যা পূরণ করার জন্য আমাকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে বলা আছে, ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব সিঙ্গাপুর’-এর মতো কীভাবে হাসপাতালটি পরিচালনা করা যায়, সেই উদ্যোগ ও চেষ্টা করছি। হাসপাতালটিতে প্রয়োজন মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকবেন। সব ধরনের রোগের চিকিৎসাই হবে সেখানে।
[৬] যারা দেশ থেকে বিদেশে যান চিকিৎসার জন্য সেই রোগীদের চিকিৎসা কীভাবে দেশে করা যায়, সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। বিদেশে রোগী যাওয়ার প্রবণতা কমাতেই সুপার স্পেশালাইজ হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। দেশেই ক্যান্সার, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট, লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, হার্টের চিকিৎসা, বাচ্চাদের ব্লাড ক্যান্সার, ইনফার্টিলিটি বা বন্ধাত্ব্যের রোগীরা বাইরে বেশি যান, এসব রোগের চিকিৎসা আমরা এখানে সন্নিবেশিত করতে চাই। এছাড়া যাদের টাক মাথা তারা হেয়ার ইমপ্লান্টের জন্য তুরস্কে চলে যায়, দেশে এই প্রথম আমি ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট করেছি। ক্যাডাভেরিক হলো একজন রোগী মৃত্যুর আগে শেষ পর্যায়ে আইসিইউতে যান, আইসিইউতে গিয়ে অনেকের ব্রেন ডেথ হয়ে যায় এবং তারা ছয় মাস পড়ে থাকেন আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশনে। সেই রোগীর ভেন্টিলেশন যখনই উইথড্র করা হয়, তিনি আর বেঁচে ফিরেন না। তাই আমরা যখন জানতে পারি তিনি আর বাঁচবেন না, কিন্তু তার আর্টিফিশিয়াল ভেন্টিলেশনের ফুসফুস ও হৃদযন্ত্র সচল আছে, তখন তার ৮টি অর্গান অন্য রোগীকে আমরা প্রতিস্থাপন করতে পারি এবং তারা সুস্থ হয়ে যেতে পারে। সারা ইসলাম নামের ২০ বছরের একটি মেয়ের মাকে আমরা মোটিভেট করতে পেরেছিলাম। কারণ তার ব্রেন ডেথ হয়েছিলো, তাকে উইথড্র করে দিলে সে মারা যাবে। তারপর তার ৪টি অর্গান আমরা নিতে পেরেছিলাম। সেটি আমাদের জন্য প্রথমবার ছিলো। তার দুটি কর্ণিয়া আমরা দুজন অন্ধ রোগীকে দিয়েছিলাম এবং দুটি কিডনি আমরা দুজন কিডনি ফেইল্যুরকে দিয়েছিলাম। আর একজন ভদ্রমহিলা নন্দিতা বড়ুয়া নামের, তিনি তার দেহ দান করেছিলেন। তিনি মারা যান সকাল ৪টার সময়, আর তারা আমার আছে আসেন সকাল ৮টার সময়। ৬ ঘণ্টা হলে আর কর্ণিয়া নেওয়া যায় না, তাই আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে তার কর্ণিয়া দুটো সংগ্রহ করি এবং দুজন অন্ধ রোগীকে দিই, এটি আগে কখনো হয়নি।
[৭] যুবক বয়সের অনেক ছেলেমেয়ে মারা যায় মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে, যারা আইসিইউতে থাকে এবং ব্রেন-ডেথ হয়ে যায়, তাদের ভেন্টিলেশন খুলে দিলে তারা আর বাঁচবে না, তাঁদের পরিবার-পরিজনরা যদি আমাদের একটু সাহায্য করেন, তাহলে আমরা সেসব রোগীর ৮টি অর্গান (হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, দুটি কর্ণিয়া, দুটি কিডনি, লিভার, বোনস, স্কিন পর্যন্ত) আমরা ট্রান্সপ্লান্ট করতে পারি। এটি আমাদের একটি সফলতা। একজন বোন তার বড় ভাইকে লিভার দিয়েছিলো, দুই ভাই-বোন এখনো ভালো আছে। এটি ছয় মাস আগের কথা। এটিও বাংলাদেশে প্রথম সফল লিভার ট্রান্সপ্লান্ট। ভারতে একটি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা লাগে। আমাদের এখান থেকে প্রতিদিন ৮০ ভাগ রোগী চলে যান চেন্নাইতে, লিভার আর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে। আমরা হিসাব করেছি, প্রতিবছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিদেশে চলে যায় শুধু চিকিৎসার জন্য। আমরা যদি অর্ধেক রোগীকেও আটকে দিতে পারি, তাহলে অন্তত ২০০ কোটি টাকা বাঁচবে দেশের। ২০০ কোটি টাকা দিয়ে আরও একটি স্থাপনা আমরা তৈরি করতে পারবো, এতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে।
[৮] প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রোগীদের দেশের বাইরে যাওয়াটা আমাদের রোধ করতে হবে। ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল চালু হয়। তারপর থেকে আউটডোরে অনেক রোগী আসেন। এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজারের ওপর রোগী আউটডোরে এসেছেন। পরামর্শ ও চিকিৎসা নিয়েছেন। যখন দেখলাম অনেক রোগী আসছেন, তখন সেখানে এমআরআই, সিটিস্ক্যান-সহ ইনভেস্টিগেশন চালু করে দিই। প্রায় ৪০ হাজার রোগীকে আমি সেবা দিয়েছি। অনেকের প্রশ্ন করতেন পারেন, ইনডোর কেন চালু করিনি তখন? কারণ তখন ডায়োলজিস্ট মেশিনের জন্য ইনডোর চালু করতে পারিনি। তাছাড়া আইসিইউর যে বেড সেটা ওঠে না, ওটি করার জন্য যে মেইন জিনিস, এনেসথেসিয়া মেশিনও ছিলো না, কোনো ইমার্জেন্সি এলে মেইন যে জিনিস দিয়ে ডিল করা হবে, সেটি নেই। এসব কারণে আমাদের বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু ২০ জুলাইয়ের মধ্যে আশিভাগ যন্ত্রপাতি আমাদের কাছে চলে আসবে। পরবর্তী সময়ে বাদবাকি যন্ত্রপাতিও আমরা পেয়ে যাবো। এ বছরের মধ্যে সব যন্ত্রপাতি ও লোকবল দিয়ে হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গা সেবা দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে আশা করছি।
[৯] আমাদের এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশেষজ্ঞ আছেন। কারণ এটি মাল্টি-ডিসিপ্লিন হাসপাতাল। তবুও আমাদের অনেক রোগী এখান থেকে বেসরকারি হাসপাতালে চলে যান। কারণ এখানে ওখানকার মতো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। যেমন ভালো বেড বা টেলিভিশন। কিন্তু বিআরবিতে আমার চিকিৎসক কেউ পাবে না। আমার এখানে বিশ্বমানের চিকিৎসক রয়েছেন। কেউ লিভারের সমস্যা নিয়ে আসলেও আমরা হার্ট বা কিডনির সমস্যা আছে কিনা জানার জন্য সেই ডাক্তারদেরও আমি এক জায়গায় আনবো। এখন যেই চিকিৎসক আছেন, এর বাইরেও আমার চিকিৎসক লাগবে, তাই ১৮০ জনের মতো চিকিৎসককে কোরিয়া থেকে ট্রেনিং দিয়ে আনা হয়েছে। এই দেশ থেকে ১৪৪ জনকে প্রিলিমিনারি কাজ করার জন্য নিয়োগ দিলাম। তারপর ৩৬০ থেকে ৩৬৫ জন কাজ শুরু করলো। রোবটিক সার্জারির পরিকল্পনাও আমাদের আছে, ভবিষ্যতে এটাও আমরা করতে পারি। লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করতে বিদেশে যদি ৫০ লাখ টাকা লাগে এখানে ২০ লাখ টাকা লাগবে। দেশের বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ৫০ ভাগ খরচ কমে যাবে এবং বিদেশে চিকিৎসার থেকে ২০০ ভাগ খরচ কমে যাবে।
[১০] বিএসএমএমইউতে আমি আসার আগে করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করা যেতো না, এখন তা করা যায়। কোন ধরনের ক্যান্সার তার জিনোম সিকোয়েন্স আমরা করছি, ডিএনএ আরএনএ সিকোয়েন্স করছি, করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার পর এন্টিবডি আছে কী নেই আগে দেখা যেতো না, এখন দেখা যায়। এগুলো নিয়ে আমরা রিসার্চ করেছি। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের বলা আছে, একদিনে ২০ জনের বেশি রোগী দেখার দরকার নেই, তাড়াহুড়ো করা যাবে না এবং ১০ মিনিটের কম কোনো রোগী দেখা যাবে না এবং সিস্টারদের বলা আছে, দিনে কয়েকবার রোগীদের কাছে যেতে হবে। আমি প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টে অনলাইন টিকিট কাটার ব্যবস্থা করেছি, এতে করে রোগীর ভিড় কমবে এবং সময়ও বাঁচবে।
শ্রুতিলিখন : জান্নাতুল ফেরদৌস। সম্পাদনা : ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
আপনার মতামত লিখুন :