এল আর বাদল : সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সুদানের ফাশির শহরে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) সন্ত্রাসীদের নৃশংস অপরাধের খবরাখবরের মধ্যে "আবু লুলু" নামে একজন অপরাধী সন্ত্রাসীর নাম সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে।
তিনি গর্বের সাথে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার ছবি প্রকাশ করেন এবং "ফাশিরের কসাই" নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাসনিম নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, এ অঞ্চলে দ্রুত উন্নয়নসহ গাজা ইস্যু এবং সেখানে যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়ার ওপর বিশ্বব্যাপী মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হওয়ার মধ্যে, গত দুই সপ্তাহ ধরে, আমিরাতের সাথে যুক্ত আরএসএফ সন্ত্রাসীদের দ্বারা সুদানে একটি বড় গণহত্যা চালানো হয়েছে এবং মিডিয়া সুদানের ওই ভয়াবহ ঘটনার খবর গোপন করতে পারেনি।
সুদানে কী ঘটছে? / ফাশিরের নরকে আটকা পড়া হাজার হাজার মানুষ
গত কয়েকদিন ধরে, সুদানের ঘটনাবলীর খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হচ্ছে, বিশেষ করে সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলিতে। সেখানকার যেসব ছবি এবং ভিডিও প্রচারিত হচ্ছে তা আরএসএফ মিলিশিয়াদের দ্বারা হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের ভয়াবহ মৃত্যুদণ্ডের ইঙ্গিত দেয়।
গত সপ্তার শুরুতে, সন্ত্রাসীরা ঘোষণা করেছিল যে তারা ৫০০ দিনের অবরোধের পর উত্তর দারফুর রাজ্যের ফাশার শহর সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এরপর এই সন্ত্রাসীদের দ্বারা অসহায় মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত নৃশংস অপরাধের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এবং প্রাথমিক পরিসংখ্যান দেখায় যে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ২,০০০ জনেরও বেশি মানুষকে ভয়াবহভাবে হত্যা করা হয়েছে।
ফাশিরের কসাই কে এই আবু লুলু ?
সুদানে আমিরাতি সন্ত্রাসীদের নৃশংস অপরাধের মধ্যে-গাজা উপত্যকায় ইহুদিবাদীদের অপরাধের সাথে যাদের কার্যক্রমের মিল রয়েছে-সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সুদানের ঘটনাবলীর সাথে সম্পর্কিত সংবাদের শীর্ষে একটি নাম উঠে এসেছে: আবু লুলু, যাকে "ফাশিরের কসাই" উপাধি দেওয়া হয়েছে।
ফাতিহ আবদুল্লাহ ইদ্রিস আসল নাম তবে আবু লুলু নামে পরিচিত। ফাশির শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগে খুব একটা পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন না তিনি, কিন্তু শহরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার পর, তার নাম ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে এবং সুদানে বর্বরতা ও সন্ত্রাসের প্রতীক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
যদিও আরএসএফ আবু লুলুর সাথে তাদের কোনওরকম সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছে এমনকি তার পরিচয় সম্পর্কে অবহিত নয় বলেও দাবি করেছে এবং পরবর্তীকালে তাকে গ্রেপ্তার করে ফাশারের "শেলা" কারাগারে আটক রাখার ঘোষণা দেয়। তবুও তিনি নিজে যে ভয়াবহ ভিডিওগুলি বারবার প্রকাশ করেছেন তা আরএসএফ সন্ত্রাসীদের সাথে তার সংযোগের ইঙ্গিত দেয় এবং মিডিয়া তাকে ফাশিরের কসাই বলে ডাকে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আবু লুলুর ছবি ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হলে অসহায় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে তার অপরাধ প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
সুদানে সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত আরএসএফ গত দুই সপ্তাহ ধরে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস অপরাধ করছে। ফাশিরের স্যাটেলাইট ছবিতে রক্তে ভরা গর্ত এবং মৃতদেহের স্তূপ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আরএসএফে'র একজন মুখপাত্র কয়েকদিন আগে ঘোষণা করেছিলেন যে ফাশার শহর দখলের সময় অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য একটি অভিযান শুরু হয়েছে।
আরএসএফ'র মুখপাত্র দাবি করেছেন, হাইকমান্ডের নির্দেশে এই গ্রেপ্তার করা হয় এবং আইনি কমিটি সন্দেহভাজনদের বিচারের আওতায় আনার লক্ষ্যে তদন্ত শুরু করেছে।
আবু লুলু বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে তার সহিংসতার নথিভুক্ত বেশ কয়েকটি অডিও ফাইল প্রকাশ করে দাবি করেছেন-তিনি কোনও দলের সাথে সম্পর্কিত নন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। একটি ফাইলে, তিনি ফাশিরে প্রায় ১,০০০ মানুষকে হত্যা করার কথা গর্ব করে বলেছেন।
যদিও অপরাধী সন্ত্রাসী কোনও দলের সাথে কোনও সম্পর্ক দাবি করেন নি, তিনি আরএসএফ-দের দ্বারা অসংখ্য আক্রমণে অংশগ্রহণ করেছেন। প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে আবু লুলুর নৃশংস অপরাধগুলো বেশিরভাগই ফাশারের উত্তরাঞ্চলে এবং তার আশেপাশে কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তবে সে যে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী তা বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে এবং তার নাম অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
পর্যবেক্ষকরা জোর দিয়ে বলেন, আবু লুলুর মতো ব্যক্তিত্বের উত্থান সুদান জুড়ে বিকশিত ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং ব্যাপক নৈতিক পতনকেই প্রতিফলিত করে, যেখানে সন্ত্রাসীরা গর্বের সাথে তাদের অপরাধের ছবি প্রকাশ করে।
রক্তের নরক এবং মৃত্যুর পথে ফাশারের উদ্বাস্তুরা
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর এবং জাতিসংঘের মানবিক সংস্থাগুলোকে ফাশারে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়ার পর, শহরটি সম্পূর্ণ সন্ত্রস্ত এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে গেছে। স্থানীয় সংস্থাগুলো জানিয়েছে, শহরের ভেতরে আটকা পড়াদের বিরুদ্ধে অপরাধ অব্যাহত রয়েছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক তাহের আল-মারজি ফাশারের কিছু সংস্থা এবং মেডিকেল নেটওয়ার্ক থেকে যেসব তথ্য প্রকাশ করেছেন তা ইঙ্গিত দেয় যে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক শহরের ভেতরে আটকা পড়েছে এবং তারা বের হতে পারছে না, এমনকি পানি কিংবা খাবারও পাচ্ছে না।
ফাশিরের দীর্ঘ অবরোধের ফলে খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং চিকিৎসা পরিষেবার তীব্র সংকট দেখা দেয় বিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে আক্রমণ এবং লুটপাটের পর।
সুদানিজ ডক্টরস নেটওয়ার্ক জানিয়েছে যে আরএসএফ এখনও হাজার হাজার বেসামরিক লোককে শহরের ভেতরে আটকে রেখেছে এবং তাদেরকে শহর ছেড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে। সন্ত্রাসীরা মানুষের ব্যবহৃত যানবাহনও জব্দ করেছে এবং পালিয়ে আসা কিছু লোককে হুমকির মুখে শহরে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে।
ফাশিরে মানবিক সংস্থাগুলো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে এবং শহরে আটকা পড়া মানুষদের ন্যূনতম সাহায্য প্রদানের জন্য লড়াই করছে। বাস্তুচ্যুতরা আশ্রয় সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের অনেকেই খোলা আকাশের নিচে বাস করছে। মানবিক করিডোর এখনও খোলা হয় নি এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক চাপের কোনও উল্লেখযোগ্য ফলাফল পাওয়া যায় নি।
প্রতিদিন ফাশিরের নরক থেকে নিজেকে বাঁচাতে এবং পালাতে সক্ষম হওয়া কয়েক ডজন পরিবার বাস্তুচ্যুতি এবং গৃহহীনতার কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যদ্বাণী করছে যে আগামী দিনে বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহ ঢেউ আসবে, যেখানে বাস্তুচ্যুতরা আশ্রয় নেওয়ার মতো কোনও জায়গা পাবে না।
ফাশির শহর থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, সন্ত্রাসীরা গাজা উপত্যকায় ইহুদিবাদীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের মতোই শহরের মানুষের শেষ আশার জায়গা যেমন ত্রাণ কেন্দ্র, রান্নাঘর, বাজার ও হাসপাতাল ইত্যাদি ধ্বংস করে দিয়েছে।
ফাশির থেকে পালাতে সক্ষম একজন সাংবাদিক বলেছেন: ফাশার শহরের সাহায্য সংস্থাগুলো গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে এবং জনগণকে সাহায্য করতে পারছে না। এই শহরের বাসিন্দারা প্রচণ্ড ক্ষুধার জ্বালায় গাছের পাতা খাচ্ছে এবং পান করার মতো পানিও পাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন: বিশ্ব গণমাধ্যমের নীরবতার সুযোগে জঙ্গিরা গুদামগুলোর অবশিষ্টাংশ পুড়িয়ে, গবাদি পশু ও ঘরবাড়ি লুট করে এবং সমস্ত পরিষেবা সুবিধা, পানির কূপ, হাসপাতালসহ বাজারঘাট সব ধ্বংস করে দিয়েছে।