বিবিসি: ‘ঘটনাটি সত্যিই বীভৎস। এই যুগে দাঁড়িয়ে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে এইভাবে মেরে ফেলার ঘটনা বিশ্বাস করা যায় না!’
ভারতের বিহারের পূর্ণিয়ার একটি গ্রামে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ডাইনিবিদ্যার অনুশীলনের অভিযোগ তুলে তাদের মারধর করে, পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
ওই গ্রামের একটি জলাশয় থেকে সোমবার তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পূর্ণিয়া সদরের সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) পঙ্কজ কুমার শর্মা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই হত্যার সাথে ঝাঁড়-ফুক, ডাইনিবিদ্যা- এই সবের যোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। নিহতদের পরিবার ঝাড়-ফুঁক করত বলে জানা যাচ্ছে।’
তিনি আরো জানান, ওই পরিবারের এক নাবালক সদস্য জানিয়েছে, ডাইনিবিদ্যা অনুশীলনের অভিযোগ তুলে তার বাড়ির পাঁচজনকে মারধর করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
এ ঘটনাটি পূর্ণিয়ার তেতগামা গ্রামের। নিহতদের মধ্যে বাবুলাল ওঁরাও নামে এক ব্যক্তি, তার স্ত্রীসহ মোট পাঁচজন রয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, দিন কয়েক আগে ওই গ্রামেরই একটি বাচ্চার মৃত্যু হয়। এরপরই অভিযোগ ওঠে ওই ঘটনার জন্য বাবুলাল ওঁরাও- এর পরিবার দায়ী। তারই জের ধরে রোববার রাতে বাবুলাল ওঁরাও এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়।
পূর্ণিয়ার ডিআইজি প্রমোদ কুমার মণ্ডল বার্তাসংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, ঘটনার সাথে যোগ রয়েছে এই সন্দেহে এ পর্যন্ত দু’জন মূল অভিযুক্তসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তিনি বলেছেন, ‘ঘটনাটি সত্যিই বীভৎস। এই যুগে দাঁড়িয়ে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে এইভাবে মেরে ফেলার ঘটনা বিশ্বাস করা যায় না!’
যেভাবে ঘটনা ঘটেছে
স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ঘটনাটি রোববার রাতের।
ডিআইজি প্রমোদ কুমার মণ্ডল সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘গ্রামের রামদেও মাহাতর পরিবারের একটি বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য বাবুলালদের ওপর চাপ দেয়া হয়। কিন্তু তা হয়নি।’
দিন চারেক আগে ওই বাচ্চাটির মৃত্যু হয়। এরপরই পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়।
অভিযোগ ওঠে বাবুলালের পরিবার ওই বাচ্চাটির মৃত্যুর জন্য দায়ী।
পুলিশ জানিয়েছে, রোববার রাতে একদল লোক বাবুলালের বাড়িতে চড়াও হয়। সেই সময় বাড়িতে উপস্থিত পরিবারের সদস্যদের বাড়ি থেকে টেনে বের করে আনা হয়, বেধড়ক মারধর করা হয় এবং পরে তাদের জ্বালিয়ে দেয়া হয়। পরে লাশ গুমের উদ্দেশ্যে স্থানীয় জলাশয়ে ফেলে দেয়া হয় বলে অভিযোগ।
ঘটনাটি রোববার ঘটলেও তা প্রকাশ্যে এসেছে সোমবার।
ওই পরিবারের জীবিত সদস্য, এক নাবালক শিশু সোমবার সকালে কোনোমতে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এসে নিকটবর্তী এক জলাশয় থেকে পাঁচজনের দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে।
ওই নাবালকের বয়ানের ভিত্তিতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই শিশুটি তার অভিযোগে উল্লেখ করেছে, বাড়িতে চড়াও হওয়া ব্যক্তিরা তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ডাইনিবিদ্যা অনুশীলনের অভিযোগ তোলে। তার মাকে ডাইনি অপবাদ দেয়া হয়। বাড়ির পাঁচজনকে মারধর করার পর তাদের জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচে যায় ওই নাবালক। পরদিন সে পুলিশকে খবর দেয়।
পুলিশ কী বলছে
পুলিশের কর্মকর্তা প্রমোদ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘ওই (ভুক্তভুগী) পরিবারেরই এক নাবালক আমাদের খবর দেয়। সে ওই ঘটনার সাক্ষী।’
তিনি জানান, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে যে অভিযুক্ত বাবুলাল পরিবারের সদস্যদের মারধর করে এবং সেখানেই তাদের মেরে ফেলা হয়। এরপর তাদের দেহ লোপাট করার জন্য বস্তাবন্দি করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে ট্র্যাক্টর নিয়ে আসা হয় দেহ অন্যত্র স্থানান্তর করার জন্য। ওই পাঁচজনের দেহ স্থানীয় একটি জলাশয়ে ফেলে দেয়া হয়, যেখান থেকে পরে পুলিশ তা উদ্ধার করে।
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের একটি দলও ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায়। ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
মণ্ডল বলেন, দু’জন মূল অভিযুক্ত বাদে ওই ট্র্যাক্টরের যে মালিক, তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ট্র্যাক্টরটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আমরা অভিযুক্ত পরিবারের আরো কয়েকজনের খোঁজ চালাচ্ছি। তবে ঘটনাস্থলে ৪০-৫০ জন উপস্থিত ছিল বলে জানা যাচ্ছে। ঘটনার সাথে কারা কারা যুক্ত তা খতিয়ে দেখা হবে।
তল্লাশির জন্য প্রমোদ কুমার মণ্ডলের নেতৃত্বে একটি দল সোমবার গভীর রাতেও ওই গ্রামে অভিযান চালায়।
‘লজ্জাজনক ঘটনা’
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিহারের আইনশৃঙ্খলা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন যে অভিযুক্তদের কড়া শাস্তি দেয়া হবে।
এসডিপিও পঙ্কজ কুমার শর্মা বলেছেন, ‘এটি অত্যন্ত গুরুতর ঘটনা। দোষীদের কাউকে কোনো মতেই রেয়াত করা হবে না। কড়া শাস্তি দেয়া হবে।’
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে করে এমন ঘটনা ঘটল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পুলিশের কর্মকর্তা প্রমোদ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘এই ঘটনা এত বীভৎস এবং সমাজের জন্য লজ্জাজনকও। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ডাইনি নিয়ে কথা বলছে। এটি লজ্জার বিষয়।’
ঘটনার নিন্দায় সরব হয়েছেন বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তেজস্বী ইয়াদভ। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ ইয়াদভের ছেলে তেজস্বী ইয়াদভ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিহারে নীতীশ কুমারের সরকারকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি।
পূর্ণিয়ার ঘটনার প্রসঙ্গে তিনি দিন কয়েক আগের অন্য এক ঘটনার কথাও টেনে এনে সে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘পূর্ণিয়ায় একই পরিবারের তিনজনকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দিয়ে হত্যা করা হলো। কয়েকদিন আগে, আরেক ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হলো।’
এরপরই মুখ্যমন্ত্রী কটাক্ষ করেন তিনি। তার কথায়, ‘অপরাধীরা সজাগ আর মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশ নেই।’