দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ও ইনচিয়ন শহরের বাসিন্দারা সম্প্রতি এক নতুন বিড়ম্বনায় পড়েছেন। শহর দুটিতে হঠাৎ দেখা দিয়েছে—প্রেম পোকা বা লাভবাগের উপদ্রব। সাধারণত এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই পোকাগুলো তাদের সঙ্গীর সঙ্গে মিলিত হয়। কিন্তু ব্যাপারটা তাদের জন্য রোমান্টিক হলেও এই পোকাদের ভিড়ে এখন রীতিমতো নাকাল রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো।
গত ২৭ জুন (শুক্রবার) দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয় সিউলের পশ্চিমে অবস্থিত গেয়েংসান পাহাড়ে এই পোকার ‘চরম মাত্রার প্রাদুর্ভাব’ মোকাবিলায় ডজনখানেক সরকারি কর্মী পাঠায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, পাহাড়ের জনপ্রিয় ট্রেইলগুলোতে হাইকিং করতে গিয়ে পোকায় ভরা ‘ঝড়ের’ ভেতর দিয়ে চলতে হচ্ছে পথচারীদের।
একজন হাইকার পুরোপুরি পোকায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছেন, আরেকজন প্লাস্টিকের কৌটায় হাজার হাজার পোকা জমিয়ে তা দিয়ে হ্যামবার্গার বানিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করেছেন—এমন ভিডিওও ছড়িয়ে পড়েছে ইউটিউবে।
কোথা থেকে এল এই ‘লাভবাগ’
এই পোকার বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্লেসিয়া লঙ্গিফোর্সেপস’ (Plecia longiforceps)। তবে উড়ন্ত অবস্থায় জোড়ায় জোড়ায় জড়িয়ে থাকার কারণে তাদের ‘লাভবাগ’ নামে ডাকা হয়। তারা সাধারণত চীনের দক্ষিণাংশ, তাইওয়ান, জাপানের রিউকিউ দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য টেক্সাস ও ফ্লোরিডাতে পাওয়া যায়।
২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথম এই পোকা শনাক্ত হয়। দেশটির পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতে, এগুলো সম্ভবত চীনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে এসেছে। ২০২২ সাল থেকে প্রতিবছর জুন-জুলাই মাসে সিউল ও এর আশপাশে বিশেষ করে বন্দর এলাকায় তাদের উপস্থিতি বাড়তে দেখা গেছে।
কেন এত দ্রুত ছড়াচ্ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বাড়ার কারণে লাভবাগরা এখন উত্তর দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, যেখানে আগে তারা ছিল না। বিশ্বের গড় তাপমাত্রার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়ছে সিউলে তাপমাত্রা। তার ওপর শহরের ‘হিট আইল্যান্ড’ প্রভাব—অর্থাৎ দালানকোঠা ও পাকা রাস্তা বেশি তাপ শোষণ করে আশপাশের এলাকা থেকে সিউলকে তুলনামূলকভাবে বেশি গরম করে তোলে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিচালক কিম টেও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, ফলে গ্রীষ্মজুড়েই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ আর উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু লাভবাগদের বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ হওয়ায় প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় এই পোকার উপস্থিতি বাড়ছে।
স্বাস্থ্যঝুঁকি কি রয়েছে?
এই পোকারা মানুষকে কামড়ায় না বা রোগ ছড়ায় না, তবে বড় সমস্যা হলো—ঘরবাড়ি, গাড়ির জানালা, ট্রেন ও রেস্টুরেন্টের দেয়ালে পোকারা ঝাঁকে ঝাঁকে বসে থাকে। তাদের ঠেকাতে এখনো কীটনাশক না ব্যবহার করে পানি ছিটানো ও আঠালো ফাঁদ ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
এরপর কোথায় ছড়াতে পারে?
কোরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে লাভবাগের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে, গেয়েংসান পাহাড়ে সম্প্রতি বড় ধরনের বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন জেলা কর্মকর্তা ওয়াং হিউন-জং। তিনি জানান, গত দুই বছরের তুলনায় এবার পোকাদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু লাভবাগদের বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যান্য এলাকাও ঝুঁকিতে রয়েছে।
করণীয় কী?
সিউল নগর কর্তৃপক্ষ লাভবাগদের ‘পরিবেশগতভাবে উপকারী’ বলেই বিবেচনা করছে। কারণ, তারা ফুলের পরাগায়ন করে এবং তাদের লার্ভা মাটির জৈব পদার্থে রূপান্তর ঘটায়। তবে বাস্তবে এই পোকাদের নিয়ে অভিযোগের হার দ্বিগুণ হয়েছে। যেমন—২০২৩ সালে যেখানে ৪ হাজার ৪১৮টি অভিযোগ ছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ২৯৬টি।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সর্বশেষ এই ‘চরম মাত্রার প্রাদুর্ভাব’ মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা হবে এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও পর্যবেক্ষণ বাড়ানো হবে। অবশ্য প্রকৃতিও কিছুটা সহায়তা করছে। স্থানীয় চড়ুই ও ময়না পাখি এই পোকা খাওয়া শিখে ফেলায় ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা কমছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
অনুবাদ: আজকের পত্রিকা