আশফিয়া মেহরিন : প্রান্তিক নারীদের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত গর্ভধারণ ঠেকাতে এবং নিরাপদ যৌন জীবনের জন্য সরকারিভাবে সরবরাহ করা উপকরণের তীব্র সংকট চলছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা এ সংকট আরও প্রকট হয়েছে গত ছয় মাসে। এমন অবস্থায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়েছে প্রান্তিক নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, বাড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ। ব্যাহত হচ্ছে নারীর স্বাভাবিক যৌন জীবন।
দরিদ্র ও প্রান্তিক বিবাহিত নারীদের কাছে সরকারিভাবে সরবরাহ করা ‘সুখী বড়ি’ সবচেয়ে জনপ্রিয় জন্মনিয়ন্ত্রণ পণ্য। অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণের মধ্যে পছন্দের তালিকায় এর পরেই আছে ইনজেকশন বা ইনজেক্টিবল এবং আইইউডি। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে এসব উপকরণ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার দরিদ্র নারীদের কাছে পৌছানো হচ্ছে। ফলে এসব উপকরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন প্রান্তিক নারীরা।
তবে এক বছরের বেশি সময় ধরে এসব উপকরণের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরও খারাপ হয়েছে পরিস্থিতি। বেশিরভাগ উপজেলায় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মজুত অন্তত ছয় মাস আগে ফুরিয়ে গেছে। এসব সামগ্রীর ওপর নির্ভরশীল দরিদ্র নারীরা পড়েছেন অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের ঝুঁকিতে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ৪৯৩টি উপজেলায় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়। সেখানে গত জুন পর্যন্ত মজুতের তথ্য রয়েছে। এতে দেখা যায়, ৪৪৪ জেলায় নেই তৃতীয় প্রজন্মের সুখী বড়ি। ইনজেক্টিব্যাল নেই ১৯৯ উপজেলায়। এছাড়া কনডমের মজুত নেই ৩১৮টি উপজেলায়।
প্রান্তিক নারীদের কাছে সরকারের জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা পৌঁছে দেয়ার কাজ করেন পরিবার কল্যাণ সহকারী ও মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরা। উপকরণ সংকটের কারণে নিয়মিত সেবাগ্রহিতা দরিদ্র নারীরা গর্ভধারণ নিয়ে আতঙ্কিত বলে তারা জানান। আর্থিক সংকটের কারণে দরিদ্র নারীরা অর্থ খরচ করে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনতেও পারছেন না। আবার অনভ্যস্ততার কারণে বেসরকারি উপকরণ নিয়েও আছে অস্বস্তি।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় ৩৭ বছর ধরে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে মাঠে কাজ করছেন মিনারা বেগম। গত ছয় মাস ধরে সুখী বড়ি, ইনজেকশন ও কনডমের সরবরাহ না থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়ছে বলে তিনি জানান।
মিনারা বলেন, ‘এখানে তো অনেকেরই (বড়ি) কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নাই। আমরা উনাদের বুঝাই যে ডেট (পিরিয়ডের) হিসাব রাখবেন। যারা কিনে খেতে পারতেছে তারা এসে বলে ওই ওষুধে (বেসরকারি) সমস্যা হয়, আগের বড়ি ভালো ছিল।‘
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ৩৩ বছর ধরে সেবা দেয়া মাঠকর্মী নাসরিন আক্তার জানান, তার এলাকার বহু দরিদ্র দম্পতি সরকারের জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীয় সেবাগ্রহিতা। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘১০ মাস ধরে ইনজেকশন নাই, ৮ মাস ধরে সুখী বড়ি নাই... অনেকেই তো কিনে খেতে পারে না।‘
গর্ভধারণের হার বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাড়ির পুরুষদের (স্বামী) বলতেছে বাজার থেকে কিনে আনো। ওরা (নারীরা) দুই-তিনদিন চলে যায় আনে না, বলে ভুলে গেছি। আসলে তো আর্থিক স্বচ্ছলতা নাই যে কিনবে, এইজন্য এসব বলে..
‘এখন মনে করেন প্রকোপটা তো বাড়তেসে। গর্ভবতীর সংখ্যা আমি অনেক নামায় আনছিলাম, এখন আবার ৫৫ পার্সেন্টের উপরে গেছে। এখন প্রতি মাসে ৪-৫ জন, এমনকি গত কয় মাসে ৮-১০ জনও পাইছি নতুন গর্ভবতী।’
প্রান্তিক এলাকার তুলনায় ঢাকার পরিস্থিতি গত দুই মাস ধরে কিছুটা ভালো। রাজধানীর দক্ষিণখানের বড়ুয়া এলাকার পরিবার পরিকল্পনা সহকারী আজিজুন নাহার লুবনা জানান, তার এলাকায় গত মাসে কিছু উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দেড় বছর ধরেই সংকট চলছিল। তখন আমরা বলছি ফার্মেসি থেকে নিয়ে (বড়ি) খান। আবার আমাদের অফিস থেকে অন্য বড়ির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। আবার যখন একদমই ছিল না, তখন আমরা বুঝিয়েছি নিরাপদ সময় বুঝে একটু কষ্ট করে মেইনটেইন করেন, যতদিন আমাদের ওষুধ না আসে। কিন্তু সরকারি বড়িগুলাই উনারা বেশি পছন্দ করেন।‘
আর্থিকভাবে একদম সামর্থ্যহীন কিছু নারীকে নিজের টাকায় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনে দিয়েছেন বলেও জানান আজিজুন নাহার লুবনা। তিনি বলেন, ‘আমার এরিয়াতে অনেককে আমিই কিনে দিছি, তারা অনেকে এসে বলে যে আমরা তো গরীব, ফার্মেসি থেকে কিনে খাওয়ার টাকা নাই। আমিই তখন কিছু টাকা দিয়ে বলতাম আপনারা কিনে নেন।‘
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে উপকরণের মজুত কমতে কমতে প্রান্তিক পর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সেবা এখন বলতে গেলে স্থবির। এর কারণ জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দায় দেন বিগত সরকারের সময়কার অব্যবস্থাপনার ওপর। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ছিল না বলেও দাবি করেন তারা। তবে সরকার বদলের পর পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার কারণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি তাদের কাছ থেকে।
অধিদপ্তরের উপকরণ ও সরবরাহ ইউনিটের উপপরিচালক আবু তাহের মো. সানাউল্লাহ নূরী বলেন, ‘আমরা নতুন দায়িত্ব নেয়ার পর কন্ট্রাসেপটিপ কেনার টাকা পাইনি। আগের আমলের সচিবের মিসম্যানেজমেন্ট ও রং ডিসিশনের কারণে আমরা কিছু কিনতে পারিনি।‘
প্রান্তিক নারীদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহারের প্রবণতা ও এ বিষয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে জানিয়ে ইউনিটের পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের হিসাবে ৬৫ শতাংশ দম্পতি বছরের কোনো না কোনো সময় কোনো না কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মধ্যে তারা থাকে। তবে ইদানিং অনেকে বেসরকারি পিলগুলো কিনে নিচ্ছেন। যেমন প্যারসিটামল কিনে নেয়, তেমন পিলও কিনে খাচ্ছে। এটাকে এসেন্সিয়াল মনে করছে।
‘আবার এই কিনে খাওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা গত এক বছরে একটু ডিজর্যাপ্ট হয়েছে। আমাদের প্রক্রিউরমেন্ট ডিলে হয়েছে। বিভিন্ন কারণে সাবেক আমলের কিছু ডিসিশনের কারণেও প্রক্রিউরিমেন্টে এমন হয়েছে। এর জন্য পরিকল্পনা ঠিকই ছিল, কিন্তু অর্থের সংস্থান ছিল না, যার কারণে বার বার ব্যাহত হয়েছে, আমরা পারিনি।‘
সরকারের পাশাপাশি প্রান্তিক নারীদের সেবায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা মেরিস্টোপস বাংলাদেশ। সংস্থাটির পার্টনারশিপ অ্যান্ড ফান্ড রাইজিং হেড মনজুন নাহার জানান, সরকারের সরবরাহ করা উপকরণ দিয়েই তারা সেবা দেন। এখন তীব্র সংকটে তাদের কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।
মনজুন নাহার বলেন, ‘দেশে পরিবার পরিকল্পনা সেবার মাত্র ৩৭ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। বাকিটা কিন্তু সরকারি সার্ভিস সেন্টার থেকে... আমাদের প্রক্রিউরমেন্ট প্রসিডিউর অনেক জটিল। বেসরকারি সংস্থারা গর্ভমেন্ট থেকে লজিস্টিকস নিয়েই কিন্তু সার্ভিস দেয়। আর কিছু এসএমসি থেকে কিনে দেয়।
‘এ অবস্থায় আমাদেরও ক্লিনিকগুলোতেও শর্টেজ পড়েছে। আমরা ইনজেক্ট্যাবল দিতে পারছি না, আইইউডি দিতে পারছি না। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সংকট চলছে।
‘এখন এই সংকটের কারণে, শহরের মেয়েরা পিল বা অন্য পদ্ধতিগুলো কিনে নিতে পারছে। কিন্তু মার্জিনালাইজড নারীদের কিন্তু এসব শহরের দিকে গিয়ে কিনতে হবে। কিন্তু পণ্যের দামের সঙ্গে যাতায়াত খরচটা একটা মার্জিনাল মেয়ে কীভাবে পাবে।‘
সংকটের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব প্রান্তিক নারীদের আরও প্রান্তিক করে তুলবে বলে আশংকা করছেন তিনি। মনজুন নাহার বলেন, ‘এটা তো একটা স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করে। তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেগনেন্সি হচ্ছে... অনেকে এর জন্য অ্যাবোর্ট করতে আসেন। সেই কিটও সরকারের মজুতে নেই। ফলে তারা ফার্মেসিতে গিয়ে কিনছেন, কীভাবে ইউজ করতে হয় তা তারা জানের না। এতে তারা মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছেন।’
এসব কারণে মাতৃমৃত্যু ও জনসংখ্যাও অনেক বেড়ে যাবে বলে আশংকা করছেন তিনি। স্বাস্থ্যখাতে নারীর প্রতি অবহেলাও এই সংকটের একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন মানবাধিকার সংগঠন ‘আমরাই পারি’ জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক। তিনি বলেন, ‘এই সংকটের কারণে প্রান্তিক নারীরা আরও প্রান্তিক হয়ে যাবেন।‘
সরকারের পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থাপনা বিশ্বের অনেক দেশের রোল মডেলে পরিণত হয়েছিল জানিয়ে জিনাত আরা হক বলেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিকগুলোয় নারীরা অনেক সহজলভ্য ও ভালো সেবা পান। এখন এমন একটা সেবা নষ্ট হয়ে গেলে দেশ হিসেবেও পিছিয়ে যাবে, আর যারা সেবা নিতেন তারাও শোচনীয় অবস্থায় পড়বেন।’
সংকট মোকাবিলায় সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপের পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে নারীর কাছে অভ্যস্ততার চেয়ে প্রয়োজনীয়তা হিসেবে প্রচার করার আহ্বানও জানান তিনি। জিনাত আরা হক বলেন, ‘প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করানো গেলে দৈনন্দিন খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে হলেও জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনে ব্যবহার করার বিষয়ে সচেতন হবেন প্রান্তিক নারীরা।’
তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় প্রান্তিক নারীদের সুরক্ষায় ক্রিশ্চিয়ান এইড, আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। প্রকল্প এলাকার আওতায় আছে রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঢাকা জেলা। এসব জায়গায় প্রান্তিক নারীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যার মধ্যে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মজুত বাড়াতে কাজ চলছে বলে জানান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাদের আশা, আগস্টের মধ্যে হয়ত মজুত বাড়ানো যাবে। সেক্ষেত্রে তিন মাসের মধ্যে সংকট অনেকটা কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।