পৃথিবী একটি নতুন ভ্রমণসঙ্গী পেয়েছে। এক ছোট্ট গ্রহাণু, যার নাম ২০২৫ PN7। মাত্র ১৯ মিটার ব্যাসের এই ক্ষুদ্র বস্তুটি এখন পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। আমাদের কক্ষপথের সঙ্গে প্রায় পুরোপুরি মিল থাকা এই গ্রহাণুটি আগামী প্রায় ছয় দশক—অর্থাৎ ২০৮৩ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করবে বলে পূর্বাভাস পাওয়া গেছে।
এই আবিষ্কার এসেছে আকাশ পর্যবেক্ষণের নিয়মিত রাতের স্ক্যান থেকে যেখানে টেলিস্কোপগুলো ধীরে চলা ম্লান বস্তুগুলোকে বারবার পর্যবেক্ষণ করে তাদের প্রকৃত গতিপথ নির্ধারণ করে।
কী এই ‘কোয়াসি মুন’?
কোয়াসি মুন এমন একটি গ্রহাণু, যে পৃথিবীর মতোই এক বছরের কক্ষপথ সম্পন্ন করে, এবং আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যেন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে মনে হয়। তবে এটি সত্যিকারের চাঁদের মতো পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে আবদ্ধ নয়। এটি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, কিন্তু তার কক্ষপথ পৃথিবীর এতটাই কাছাকাছি যে দীর্ঘ সময় আমাদের প্রতিবেশী হয়ে থাকে।
২০২৫ PN7–কে কীভাবে শনাক্ত করা হল?
কেমব্রিজ, ম্যাসাচুসেটসের মাইনর প্ল্যানেট সেন্টার (MPC) বিশ্বজুড়ে গ্রহাণু পর্যবেক্ষণের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের দায়িত্বে থাকে। তারা এই গ্রহাণুর কক্ষপথের গণিত যাচাই করে নিশ্চিত করেছে যে ২০২৫ PN7 সত্যিই পৃথিবীর মতো সময় নিয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
নাসার ডেটাবেসে এটি একটি Near-Earth Object হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে, এবং এর কক্ষপথ স্পষ্টভাবে দেখায় যে এটি সাধারণ উল্কাপিণ্ডের মতো শুধু পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে না—বরং দীর্ঘমেয়াদি সহচর।
হাওয়াইয়ের দল আগস্ট মাসে প্রথম এর তথ্য পাঠায়। গ্রহাণুটি খুবই ম্লান হওয়ায় এতদিন শনাক্ত করা যায়নি। এর ‘অ্যাবসোলিউট ম্যাগনিটিউড’—যা ছোট ও অন্ধকার জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বলতার মান—জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আকার বুঝতে সাহায্য করেছে।
কেন এটি পৃথিবীর কাছে থাকে?
কোয়াসি মুনের অস্তিত্ব টিকে থাকে মিন মোশন রেজোন্যান্স (MMR)–এর কারণে—যেখানে দুটি বস্তুর কক্ষপথ এমনভাবে সিঙ্ক হয় যে তারা একই সময়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। ২০২৫ PN7 পৃথিবীর মহাকর্ষে আবদ্ধ না হলেও সূর্য এবং গ্রহগুলোর সামান্য টানের কারণে দীর্ঘ সময় আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।
কম আকারের কারণে সূর্যালোকের তাপ, পুনঃনির্গমিত বিকিরণ এবং সূক্ষ্ম মহাকর্ষীয় টান—সব মিলিয়ে এর কক্ষপথ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে সিমুলেশন দেখায়, এই সম্পর্ক কয়েক দশক স্থায়ী হওয়াই স্বাভাবিক।
কেন বিজ্ঞানীরা এতে আগ্রহী?
এই ধরনের গ্রহাণু ছোট বস্তুর কক্ষপথগত আচরণ বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর আরেক দীর্ঘমেয়াদি কোয়াসি মুন কামো`ওআলেভা–র ক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা গিয়েছিল এর পৃষ্ঠে চাঁদসদৃশ খনিজ পদার্থ রয়েছে—যা ইঙ্গিত দেয় যে এমন কিছু গ্রহাণু হয়তো বহু আগে সংঘর্ষে খণ্ডিত হয়ে গেছে।
কোয়াসি মুনগুলো ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশনের জন্যও উপকারী। এগুলোর গতি তুলনামূলক ধীর, ফলে রেনডেভু, নমুনা সংগ্রহ বা প্রযুক্তি পরীক্ষা সহজ হয়। নেভিগেশন সফটওয়্যার, রোবোটিক হাত, ধুলোর আচরণ—সবই পরীক্ষা করা যায় ঝুঁকি কম রেখে।
এটি কি আমাদের দ্বিতীয় চাঁদ?
না। আমাদের প্রকৃত চাঁদ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে বাধা। কিন্তু ২০২৫ PN7 সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে এবং শুধু কক্ষপথের মিল থাকার কারণে কাছাকাছি থাকে। এটি জোয়ার-ভাটা বদলাবে না, রাতের আকাশ আলোকিত করবে না—এমনকি টেলিস্কোপেও দেখা যাবে না।
এটি কোনো অস্থায়ী উপগ্রহও নয়, যা পৃথিবীর অল্প সময়ের জন্য আটকায় এবং পরে সরে যায়। ২০২৫ PN7–এর কক্ষপথ স্থিতিশীল, এবং এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ—পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের কোনো সম্ভাবনা নেই। সব মিলিয়ে, এই নতুন গ্রহাণু পৃথিবীর সঙ্গে মহাকাশে এক নীরব সহযাত্রী—যা আমাদের সৌরজগতের জটিল নৃত্য আরও ভালোভাবে বোঝার সুযোগ করে দিচ্ছে।
সূত্র: ইনকিলাব