জাকির হোসেন তপন: নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘কোনও জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক বোমা বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। এর জন্য প্রয়োজন শুধু শিক্ষার মান নীচে নামিয়ে আনা এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় জালিয়াতির সুযোগ দেওয়া’। অর্থাৎ নষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা ‘শিক্ষিত’ বলে ছাড়পত্র পাবে তাদের দ্বারা যেসব ঘটনা ঘটতে থাকবেÑচিকিৎসকদের হাতে রোগী মারা যাচ্ছে। প্রকৌশলীদের হাতে ভবন ধসে পড়ে। অর্থনীতিবিদ এবং হিসাবরক্ষকদের হাতে অর্থ হারিয়ে যায়। মানবতার মৃত্যু হয় এ ধরনের ধর্মীয় পণ্ডিতদের হাতে। বিচারকদের হাতে ন্যায়বিচার নষ্ট হয়ে যায়... অর্থাৎ ‘শিক্ষার পতন একটি জাতির পতন’।
প্রকৃত শিক্ষিত আর জ্ঞানী মানুষেরা সৎ জীবন যাপনে সচেষ্ট থাকেন। তাঁদের মুখের কথা আর কাজে খুব বেশি ফারাক তাই খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁদের বলা কথাগুলোও সারা পৃথিবী ব্যাপী যুগে যুগে মানুষ সমস্যা আর অবস্থা ব্যাখ্যা করতে তাই ব্যবহার করেন। ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় এসে তাঁর স্বদেশি মানুষের দ্বারা নানা ধরনের অনৈতিক/অন্যায় চাপে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো অন্যায়ের কাছে হেরে যাননি, আপোস করেননি।
ছোটবেলায় এই গল্পটি শুনেছিলাম। এক ‘খারাপ’ ব্যক্তি একবার হযরত মুহম্মদ (সা.) এর কাছে গেলেন, উদ্দেশ্য তিনি ভালো হয়ে যেতে চান। প্রায় সব ধরনের খারাপ স্বভাব, অভ্যাসই সেই লোকের ছিল। কিন্তু তিনি সব অভ্যাস একবারে ছাড়তে পারবেন না। প্রথমবার কেবল একটি ছাড়বেন; এ ব্যাপারে তিনি নবীজীর পরামর্শ কামনা করলেন। সব শুনে নবীজী চিন্তায় পড়লেন। তারপরে ভেবেচিন্তে বললেন, ‘আপনি মিথ্যা কথা বলা ছাড়ুন।’ ওই লোক তো দারুণ খুশি, শুধু মিথ্যা বলা ছাড়লেই হবে! এর কিছুদিন পরেই ওই লোক আবার এলেন নবীজীর কাছে, বললেন, আমি মিথ্যা বলা ছেড়ে দেওয়ার কারণে আর কোনো অপরাধই করতে পারছি না। অর্থাৎ সব অপরাধমূলক কাজ, খারাপ স্বভাবকে সচল রাখতে হলে মিথ্যাচার অপরিহার্য! মিথ্যাচার একেবারে বন্ধ মানেই হলো বাকি সবেরও যবনিকাপাত!
আমি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক শিক্ষক নির্যাতন, সর্বগ্রাসী রুচির দীনতা আর অবক্ষয়কে আলাদা করে দেখছি না। রাষ্ট্র যখন সঠিক পথে পরিচালিত হয় না, অর্থাৎ সংবিধান, ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ বাক্য পাঠ করেও যারা তাঁর ওপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন না (বা ব্যর্থ হন) তখন রাষ্ট্রে নানা ধরণের অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশ তৈরি হয়। রাষ্ট্র তথা সরকারের, তা সে যে দেশই হোক, প্রধান ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব/ কাজ হলো দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। পৃথিবীর দেশে দেশে তাকিয়ে দেখুন যারাই এই মূলনীতিকে খুব কঠিনভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন সেসব দেশ আজ শিক্ষায়, জ্ঞানে, সৌন্দর্যে, জন নিরাপত্তায়, সু-শাসনে, ধনে, সম্মানে শীর্ষে।
অত্যধিক মানহীন জনসংখ্যার চাপে এই ভারতীয় উপমহাদেশের অঞ্চল গুলোতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সব সময়ই রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরণের প্রভাব রেখে থাকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নানা উদাহরণ যেমন এই অঞ্চলে রয়েছে, তেমনি চরম অসহিষ্ণুতার বীভৎস সব উদাহরণ সব সময়ই ছিল, ইদানীং তা যেন বেড়ে চলেছে আরও! এখানেও চলে আসছে ওই শিক্ষার মানের ব্যাপারটা। একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ কখনোই সাম্প্রদায়িকতার মতো নিম্নশ্রেণীর আবেগ দ্বারা পুরোমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত হন না। সে চালিত হয় যুক্তি দিয়ে, কার্য কারণ দিয়ে। সে কখনোই একের অপরাধের দায় নির্মম ভাবে অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারে না।
তাই শিক্ষার উচ্চ মান নিশ্চিত করুন, আইনকে তাঁর নিজ গতিতে চলতে দিন, বিচার বিভাগ, প্রশাসনকে সংবিধান দ্বারা চালিত হবার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনুন। দেখবেন শিক্ষককে পিটিয়ে মেরে ফেলা, জুতোর মালা দেয়া, অপমান করা, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ কর্তৃক ছাত্র ধর্ষণ, স্কুল পড়ুয়ার মোবাইলের জন্য বন্ধুকে হত্যা, সেতুতে মূত্র ত্যাগ- এসব কমতে কমতে নাই হয়ে যাবে। প্রতিটি মানুষ যখন এটা নিশ্চিত ভাবে জানবে যে অপরাধ করলে শাস্তি থেকে কোনোভাবেই রেহাই নেই, তখন অপরাধ অবশ্যই কমে যাবে। বিশে^ুর সফল দেশগুলো সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে। ফেসবুক থেকে