নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছালেও এর প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন এবং কীভাবে তিনি নির্বাচিত হবেন, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর ধারাবাহিক আলোচনায় এই পদের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব উঠে এসেছে, যা নিয়ে আরও আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
পটভূমি
একসময় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু ছিল। তবে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এটি বাতিল করা হয়। যদিও হাইকোর্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর দুটি ধারাকে সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করেছে, এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ আবেদনগুলো এখনও শুনানির অপেক্ষায় আছে।
এরই মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে একাধিক প্রস্তাব বর্তমানে আলোচনার টেবিলে রয়েছে। প্রধান প্রস্তাবগুলো নিচে তুলে ধরা হলো:
১. সংবিধানের সাবেক বিধান (ত্রয়োদশ সংশোধনী)
পদ্ধতি: সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। তিনি অপারগ হলে বা পাওয়া না গেলে ক্রমানুসারে তার পূর্ববর্তী অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা তার পূর্ববর্তী জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
বিকল্প: উপরে উল্লিখিত কাউকে পাওয়া না গেলে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি একজন নাগরিককে নিয়োগ দেবেন। এটিও সম্ভব না হলে রাষ্ট্রপতি নিজেই অতিরিক্ত দায়িত্ব নেবেন।
দলগুলোর অবস্থান: বিএনপি বিচার বিভাগকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখতে চায়। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশিরভাগ দল রাষ্ট্রপতিকে এই দায়িত্ব দেওয়ার বিপক্ষে।
২. জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র প্রস্তাব
সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগে ১১ সদস্যের একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করা হবে, যেখানে দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে।
সরকারি দল, প্রধান বিরোধী দল ও অন্যান্য দলগুলো মিলে মোট ৯ জন নির্দলীয় ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে।
সংসদীয় কমিটি ৮-৩ ভোটে একজনের নাম চূড়ান্ত করবে।
ব্যর্থ হলে, প্রস্তাবিত নামগুলো থেকে উচ্চকক্ষ ‘র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’ (পছন্দের ক্রমানুসারে ভোট) পদ্ধতিতে একজনকে নির্বাচন করবে।
সমর্থন: বাংলাদেশ জাসদের মতো কিছু দল এই প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে।
৩. নাগরিক কোয়ালিশনের প্রস্তাব
সংসদ বিলুপ্তির দুই মাস আগে একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠিত হবে, যেখানে সরকারি দল থেকে ৬ জন এবং বিরোধী দল থেকে ৫ জন সদস্য থাকবেন।
সরকারি ও বিরোধী দল প্রত্যেকে ৩ জন করে মোট ৬ জন প্রার্থীর নাম প্রস্তাব করবে।
কমিটিকে ৮ জনের সম্মতিতে একজনের নাম চূড়ান্ত করতে হবে।
ব্যর্থ হলে, উচ্চকক্ষ ‘র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতিতে ৬ জনের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করবে।
৪. আলোচনায় আসা অন্যান্য প্রস্তাব
রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: সংবিধানের পুরোনো বিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধান দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একজন যোগ্য নাগরিককে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে পারেন।
স্পিকারের নেতৃত্বে কমিটি: সংসদের স্পিকারের সভাপতিত্বে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যারা আলোচনার মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নাম চূড়ান্ত করবে।
জামায়াতে ইসলামীর পুরোনো প্রস্তাব: দলটি এর আগে দুটি বিকল্প দিয়েছিল—হয় সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া, অথবা প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে একটি অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি গঠন করা, যারা প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়ন দেবে। তবে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় দলটি এই প্রস্তাব এখনো পুনরায় উপস্থাপন করেনি।
ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও উপসংহার
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখবে। কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, সব দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে একমত এবং প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে অনেক কাছাকাছি এসেছে, যা একটি ইতিবাচক দিক। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আরও আলোচনার প্রয়োজন হবে। উৎস: প্রথম আলো।