মৃত্যু এমন এক সঠিক সত্য, যেখান থেকে কেউ পালাতে পারে না। মানুষ দুনিয়ায় যত ব্যস্তই থাকুক, শেষ অবধি তাকে নামতে হবে সেই নীরব ঘরে—কবরের অন্ধকারে। কবরই আখিরাতের প্রথম মনজিল; এখানেই শুরু সুখের যাত্রা বা দুঃখের পরীক্ষা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—সবাইকে সেখানে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না। কিছু সৌভাগ্যবান আল্লাহর বিশেষ রহমতে কবরের ফিতনা ও প্রশ্ন থেকে মুক্ত ও নিরাপদ থাকবেন।
কে তারা? কেন তারা বিশেষ মর্যাদা পাবেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েক শ্রেণির লোকের কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। তাদের পরিচয় জানলে মনে আলো জ্বলে ওঠে, দুনিয়ার কষ্টও সহজ মনে হয়। যেসব সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে কবরের প্রশ্ন করা হবে না, তারা হলেন-
১. যারা ইসলামি ভূখণ্ড বা সীমান্ত পাহারা দিতে গিয়ে মারা যান
হযরত সালমান ফারেসি (রা.) বলেন, আমি শুনেছি, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
رِبَاطُ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ خَيْرٌ مِنْ صِيَامِ شَهْرٍ وَقِيَامِهِ وَإِنْ مَاتَ جَرَى عَلَيْهِ عَمَلُهُ الَّذِى كَانَ يَعْمَلُهُ وَأُجْرِىَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ وَأَمِنَ الْفَتَّانَ
‘একটি দিন ও রাতের প্রতিরক্ষা কাজ একমাস (নফল) সিয়াম ও নামাজ অপেক্ষা উত্তম। মরার পরও তার সেই আমল জারি থাকে যা সে জীবিত অবস্থায় করত। তার রুজি জারি হয় এবং (কবরের) যাবতীয় ফিতনা থেকে সে নিরাপত্তা লাভ করে।’ (মুসলিম ৫০৪৭, তিরমিজি ১৬৬৫, নাসাঈ ৩১৬৮)
এরা মৃত্যুর পর প্রথম মনজিলেই নিরাপদ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হন।
২. যারা আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হন
হজরত মিকদাম ইবনে মাদি কারিব (রাঃ) বর্ণনা করেন—
لِلشَّهِيدِ عِنْدَ اللَّهِ سِتُّ خِصَالٍ يُغْفَرُ لَهُ فِي أَوَّلِ دَفْعَةٍ وَيَرَى مَقْعَدَهُ مِنَ الْجَنَّةِ وَيُجَارُ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَيَأْمَنُ مِنَ الْفَزَعِ الأَكْبَرِ وَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ تَاجُ الْوَقَارِ الْيَاقُوتَةُ مِنْهَا خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا وَيُزَوَّجُ اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِينَ زَوْجَةً مِنَ الْحُورِ الْعِينِ وَيُشَفَّعُ فِي سَبْعِينَ مِنْ أَقَارِبِهِ
শহিদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে ছয়টি পুরস্কার বা সুযোগ আছে—
> তার প্রথম রক্তবিন্দু পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ক্ষমা করা হয়
> তাকে তার জান্নাতের বাসস্থান দেখানো হয়
> কবরের আজাব হতে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়
> সে কঠিন ভীতি হতে নিরাপদ থাকবে
> তার মাথায় মর্মর পাথর খচিত মর্যাদার টুপি পরিয়ে দেওয়া হবে। এর এক একটি পাথর দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছু হতে উত্তম।
> তার সঙ্গে ৭২ জন জান্নাতি হুরকে বিয়ে দেওয়া হবে
> তার ৭০ জন নিকটাত্মীয়ের জন্য তার সুপারিশ কুবুল করা হবে। (তিরমিজি ১৬৬৩)।
শহিদের প্রথম রক্তবিন্দু পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে ক্ষমা করা হয় এবং কবরের প্রশ্নও তাকে স্পর্শ করে না।
৩. যারা রাতের বেলায় নিয়মিত সুরা মুলক তিলাওয়াত করেন
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন—
هِيَ الْمَانِعَةُ هِيَ الْمُنْجِيَةُ تُنْجِيهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ
‘এ সুরাটি (সুরা মুলক) হলো প্রতিরোধকারী, নাজাত দানকারী। এটি তিলাওয়াতকারীকে কবরের আজাব থেকে উদ্ধার করে।’ (তিরমিজি ২৮৯১)
সুরা মুলক প্রতিদিন পড়া যেন কবরের অন্ধকারে একটি আলো হাতে নেওয়ার সমান।
৪. জুমার দিন বা রাতে মৃত্যুবরণকারী
হযরত আদুল্লাহ ইবনু আমর (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ إِلاَّ وَقَاهُ اللَّهُ فِتْنَةَ الْقَبْرِ
‘জুমআর দিনে অথবা জুমআর রাতে কোনো মুসলিম ব্যক্তি যদি মৃত্যুবরণ করে তাহলে কবরের ফিতনা থেকে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেন।’ (তিরমিজি ১০৭৪)
এটি সৎ ঈমানদারের জন্য একটি সুস্পষ্ট সৌভাগ্যের নিদর্শন।
৫. যারা পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন (শহীদের মর্যাদায়)
হযরত আবু হুরায়রাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন-
الْمَبْطُونُ شَهِيدٌ وَالْمَطْعُونُ شَهِيدٌ
‘উদরাময় রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ, আর প্লেগ রোগে মৃত ব্যক্তি শহীদ।’ (বুখারি ৫৭৩৩)
শহীদের মতো তারও কবরের প্রশ্ন হবে না। কারণ এ ধরনের মৃত্যু অত্যন্ত কষ্টদায়ক—আর ধৈর্যসহকারে মৃত্যুবরণকারীদের জন্য মহান পুরস্কার রয়েছে। পাশাপাশি যারা আগুনে পুড়ে মারা যান, পানিতে ডুবে মারা যান, দুর্ঘটনায় বা চাপা পড়ে মারা যান—হাদিসে তাদেরও শহীদের মর্যাদা উল্লেখ আছে এবং শহীদের জন্য কবরের ফিতনা নেই।
৬. নাবালক শিশু এবং মাতৃগর্ভে মৃত্যু হওয়া শিশু
অপ্রাপ্ত বয়সে কোনো শিশু মারা গেলে তাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। প্রখ্যাত আকাইদবিদ আল্লামা নাসাফি (রহ.) দৃঢ়তার সঙ্গে বিষয়টি ব্যক্ত করেছেন। ইমাম নববিও (রহ.) অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে সালাহ (রহ.) বলেন, শিশু মারা গেলে তাকে কালিমায়ে শাহাদাতের তালকিন করারও দরকার নেই। আর সেসব শিশুদেরও সাওয়াল করা হবে না; যারা মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় মারা যায়।
৭. মানসিক বিকারগ্রস্ত (পাগল) বা বুদ্ধিহীন ব্যক্তি
যাদের ‘আক্ল’ নেই, মানসিক ভারসাম্যহীন— তাদের ওপরও শরিয়তের দায়িত্ব নেই। তাই তাদের কবরের প্রশ্ন সম্পর্কে ইমামদের বক্তব্য— তাদের প্রশ্ন করা হবে না।
যাদের ওপর আল্লাহ কবরের কঠিন পরীক্ষা সহজ করে দেন—তারা প্রকৃত সৌভাগ্যবান। এই সাত শ্রেণির মানুষ সেই সৌভাগ্যের অধিকারী—
✔ সীমান্ত পাহারাদার
✔ শহিদ
✔ নিয়মিত সুরা মুলক পাঠকারী
✔ জুমার দিন বা রাতে মৃত্যুবরণকারী
✔ পেটের রোগে ধৈর্যসহকারে মৃত্যুবরণকারী
✔ নাবালক বা গর্ভে মৃত শিশু
✔ মানসিক বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি
মৃত্যুর পরের অন্ধকার ঘর কবর— সেখানে কেউ আমাদের সঙ্গী হবে না; না সম্পদ, না মর্যাদা, না পরিবার। শুধু ঈমান, আমল এবং আল্লাহর রহমতই সেখানে নিরাপত্তা দিতে পারে। সৌভাগ্যবান সেই সব মানুষ, যাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) কবরের প্রশ্ন ও ফিতনা থেকে মুক্তির সুসংবাদ দিয়েছেন। সত্যিই এটি এমন এক সৌভাগ্য, যা দুনিয়ার সব অর্জনকেই তুচ্ছ করে দেয়।
এই সাত শ্রেণির মানুষ আমাদের শেখায়— আল্লাহর পথে জীবনের মূল্য দিতে পারলে, নিয়মিত ইবাদত ও সৎকর্মে লেগে থাকলে, ধৈর্য ধরে কষ্ট সহ্য করলে এবং ঈমান নিয়ে বিদায় নিলে— আল্লাহ তার বান্দাকে কখনো একাকী ফেলে রাখেন না।
আমরা যেন এমন কাজের সঙ্গে জীবনকে যুক্ত করি, যা কবরের অন্ধকারকে আলো করে দেয়, আর আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য নিরাপত্তার দরজা খুলে দেয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবার শেষ পরিণতি সুন্দর করুন, কবরের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করুন এবং তার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।
সূত্র: যুগান্তর