শিরোনাম
◈ এবার শেখ মুজিবের সেই ভাস্কর্য ভাঙল ছাত্র-জনতা (ভিডিও) ◈ অ‌নেক ক‌ষ্টে ম্যানইউকে হারা‌লো ‌চেল‌সি, আ‌রেক ম‌্যাচে অ‌্যাস্টন ভিলার জয় ◈ যে কারণে আজ খোলা সরকারি অফিস ◈ ভারত কি ট্রাম্পকে শূন্য শুল্কের প্রস্তাব দিয়েছে?  ◈ ধারণার চেয়ে অনেক আগেই বিলীন হবে মহাবিশ্ব: ব্ল্যাকহোল বিশেষজ্ঞ ◈ শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা: হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ড, ৩ আসামিকে খালাস ◈ আ‌মিরা‌তের বিরু‌দ্ধে প্রথম ম্যাচ আজ, সি‌রিজ জ‌য়ে আশাবাদী লিটন দাস ◈ ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনের প‌রিচালনা পর্ষদ‌কে অপসারণের নির্দেশ আদালতের ◈ ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের ভূমিকা দাবি ট্রাম্পের, ভারত বল‌ছে অ‌যৌ‌ক্তিক ◈ চার দশক পর জাতিসংঘের মঞ্চে নেতৃত্বের দৌড়ে বাংলাদেশ

প্রকাশিত : ১৭ মে, ২০২৫, ০১:০১ রাত
আপডেট : ১৭ মে, ২০২৫, ১১:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মোগল দরবার থেকে মক্কা: আকবর ও হজ কাফেলার ইতিহাস

৭ অক্টোবর ১৫৭৬। রাজদরবারে পিনপতন নিরবতা, ভক্তি, ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতার আবহে পরিপূর্ণ। হীরা, জহরত ও দামী অলঙ্কারে সজ্জিত রাজদরবার আজ যেন শিল্পীর আঁকা স্থির চিত্র মাত্র।

দরবারের সভাসদ ও মন্ত্রীবর্গ—যারা ঝলমলে পোশাক পরিধান করে আছেন, যাদের কোমরে শোভা পাচ্ছে ঐশ্বর্যের তরবারি তাদের মুখমণ্ডলে গর্ব-গরিমার পরিবর্তে প্রস্ফূটিত হয়েছে পবিত্র আভা।

রাজপ্রহরীরাও আজ অশ্রুসিক্ত আর হূদয় আবেগে উদ্বেলিত। কেননা আজ তারা এমন দৃশ্য দেখছে যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। সম্রাট আজ রাজকীয় পোশাক, অলঙ্কার ও মুকুট পরিধান করে নয়, বরং তিনি ইহরামের দুই টুকরো সাদা কাপড় পরে দরবারে প্রবেশ করেছেন।  আজ তাঁর পায়ে স্বর্ণের সুতোয় সেলাই করা নকশাকার জুতাও নেই। তিনি খালি পায়ে, খালি মাথায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশ্যে কথা বলছেন। তাঁর মাথার চুলও এক পাশে মুণ্ডন করা।  আজ তিনি কোনো প্রতাপশালী শাসক নন, আজ তিনি আল্লাহর পথের পথিক। তিনি আল্লাহর ঘরের মেহমান হতে এখনি যাত্রা শুরু করবেন এবং যাত্রার যাবতীয় প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছে।

বাদশাহ হজ কাফেলার সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। তাদের সঙ্গে শহর ছেড়ে কিছু দূর অগ্রসরও হন। কিন্তু তখনই সৈনিকরা মিথ্যা মাতমে বাদশাহ বিভ্রান্ত করে। বাদশাহ তাদের মাতম উপেক্ষা করে কিছু দূর অগ্রসর হলেন বটে, কিন্তু তাঁর হজে যাওয়া হলো না। সম্রাট হজ কাফেলাকে বিদায় দিলেন এবং বায়তুল্লাহ জিয়ারতের আক্ষেপ বুকে নিয়ে প্রাসাদে ফিরে এলেন। মোল্লা আবদুল কাদের বাদায়ুনি তাঁর ‘মুনতাবুত তাওয়ারিখ’ বইয়ে এভাবেই সম্রাট আকবরের অসমাপ্ত হজযাত্রার চিত্র তুলে ধরেছেন। ১৫৭৬ সালে যখন সম্রাট আকবরের অন্তরে বায়তুল্লাহ জিয়ারতের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়ে উঠেছিল, তখন সাম্রাজ্য তাঁর পায়ে শিকল হয়ে আটকে গিয়েছিল।

আইনে আকবরের লেখক আবুল ফজল আল্লামি লেখেন, সেনাপতি, প্রশাসক ও রাজন্যবর্গের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত হজের ইচ্ছা থেকে সরে আসেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা, রাজন্যবর্গ অনুরোধ না করলেও সম্রাটের জন্য হজের সফরে যাওয়া সহজ ছিল না। কেননা দীর্ঘ অনুপস্থিতি তাঁর রাজত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিত। বিশেষত মধ্যযুগে ভারতবর্ষে ক্ষমতার পথ ছিল অত্যন্ত পিচ্ছিল। স্বয়ং সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বকালে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি বিদ্রোহের মুখে পড়েন। তাঁর অবস্থা এমন ছিল তিনি বাংলার দিকে মনোযোগ দিলে কাবুল হাত থেকে ছুটে যেত। আর কাবুল ধরতে গেলে গুজরাটে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যেত।

সম্রাট আবকর হজে যেতে না পারলেও তিনি হজযাত্রীদের নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রীয় খরচে নাগরিকদের হজে পাঠানোর বিধান করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর জনসাধারণকে রাষ্ট্রীয় খরচে হজ করার আহ্বান জানান। সে বছর সুলতান খাজা নকশাবন্দির নেতৃত্বে বিরাট হজকাফেলা প্রেরণ করেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণ হজযাত্রীদের পাশাপাশি কিছু মানুষকে জোরপূর্বক আরব ভূখণ্ডে পাঠিয়ে দিত। যেমন সম্রাট হুমায়ুন তাঁর দুই বিদ্রোহী ভাই শাহজাদা কামরান ও শাহজাদা মুহাম্মদ আস্কারিকে মক্কায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং সেখানেই তারা মৃত্যুবরণ করেন।

সম্রাট আকবর প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় খরচে হজ কাফেলা পাঠাতেন। তিনি তাঁর আমলে ‘আমিরুল হজ’ (হজ কাফেলার প্রধান) পদ সৃষ্টি করেন। তিনি হজকাফেলার সঙ্গে মক্কা-মদিনার অধিবাসীদের জন্য বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন পাঠাতেন। সম্রাট আকবর হাজিদের বিদায় দেওয়ার তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করতেন। যেমন তিনি ইহরাম পরতেন, মাথার চুল ছোট করতেন, তালবিয়া পাঠ করতেন এবং খালি মাথায়, খালি পায়ে হাঁটতেন।

১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমিরুল হজ শাহ আবু তুরাব (রহ.) হজ থেকে ফিরে আসার সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পদচিহ্ন বিশিষ্ট একটি পাথর নিয়ে আসেন। রাসুল (সা.)-এর স্মৃতিচিহ্নের প্রতি সম্মান এবং হাজিদের অভ্যর্থনা জানাতে আগ্রা শহরের বাইরে তিনি চার ফারসাখ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যান।

আবুল ফজল আল্লামি লেখেন, ১৫৭৯ সালে সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় তাঁর ফুফি গুলবদন বেগম, স্ত্রী সেলিমা সুলতান বেগমসহ রাজপরিবারের একাধিক নারী হজে গমন করেন। খাজা ইয়াহইয়া এই কাফেলার আমিরুল হজ ছিলেন। তারা ১৫ অক্টোবর ১৫৭৫ সালে আগ্রা থেকে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৫৭৬ সালের অক্টোবর মাসে সুরত থেকে দুটি জাহাজে করে মক্কা ও মদিনার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এই কাফেলা ১৫৭৭ সালে জেদ্দায় পৌঁছায় এবং সেখানে প্রায় চার বছর অবস্থান করে। এই সময়ে তারা চারবার হজ পালন করেন।

১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে হজ শেষে তাঁরা ফিরে এলে তাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। খাজা ইয়াহইয়ার মাধ্যমে মক্কার অভিজাত ব্যক্তিরা সম্রাটের কাছে সাহায্য চেয়ে একটি তালিকা পাঠিয়ে ছিল। এছাড়াও সম্রাট মক্কা-মদিনার অসহায় ও দরিদ্র মানুষের তালিকা চেয়ে পাঠান এবং তাদের জন্য সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরের বছর সম্রাট তাদের দাবি অনুসারে উপহার ও সাহায্য পাঠান.

ঐতিহাসিক সূত্রগুলো বলে, প্রথম বছর সম্রাট আকবর তাদের জন্য ছয় লাখ রুপি এবং ১২ হাজার পোশাক পাঠান। পরের বছর পাঁচ লাখ রুপি ও ১০ হাজার পোশাক পাঠান। তৃতীয় বছর চার লাখ রুপি এবং নয় হাজার পোশাক পাঠান। সম্রাটের সহযোগিতায় হিজাজে একটি মাদরাসা ও কাদেরিয়া তরিকার খানকাও প্রতিষ্ঠিত হয়। মিথ্যা ধর্ম দ্বিনে এলাহির প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত সাহায্য পাঠানোর এই ধারা অব্যাহত ছিল। এরপর শুরু হয়েছিল সম্রাট আকবরের দুর্ভাগ্যের দিন।

পরবর্তী মোগল সম্রাটরা আরবে সাহায্য পাঠানোর এই ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন। তবে এর উদ্দেশ্য কেবল ধর্মভক্তি ছিল না। তাদের কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। ইতিহাস গবেষকরা বলেন, মোগল সম্রাটরা বিপুল পরিমাণ উপহার পাঠাতেন কয়েকটি উদ্দেশ্যে:

১. মক্কা-মদিনার সঙ্গে ধর্মীয় সম্পর্ক ও পবিত্র ভূমির প্রতি সম্মান,

২. মুসলিম বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করা,

৩. মক্কা-মদিনার শাসকরা যেন ভারতীয় হাজিদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রতি সুদৃষ্টি দেন,

৪. আরব বিশ্বে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

তথ্যঋণ: ইন্ডিপেন্ডেন্ট উর্দু, মক্কা নিউজ ডটএসএ ও নিউজ২৪

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়