এল আর বাদল : দিল্লিতে প্রায় দেড় দশক ধরে ভাঙ্গারির কাজ করা দুটি পরিবারের ছয়জনকে 'বাংলাদেশি' হিসেবে দেখিয়ে কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তবে এখন প্রায় দশটি নথি যোগাড় করেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ, যা থেকে দেখা যাচ্ছে অন্তত একটি পরিবার আসলে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলারই বাসিন্দা এবং তারা ভারতের নাগরিক। বীরভূমের মুরারই থানার ওসি বিভিন্ন সরকারী দফতর থেকে ওই দশটি নথি সংগ্রহ করেছেন। অন্য পরিবারটির বাড়ি বীরভূমেরই পাইকর থানা এলাকায়। তাদের নথি যোগাড় ও যাচাই কাজ এখনও চলছে।
এর আগে দিল্লির পুলিশ তথ্য দিয়েছিল যে, এরা বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার মোলারগাং ছেপুয়ার পাড় গ্রামের বাসিন্দা। --- সূত্র, বিবিসি বাংলা
বীরভূমের পুলিশের যোগাড় করা নথি ছাড়াও তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যান পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম এমন কয়েকটি জমির দলিলের তথ্য সংগ্রহ করেছেন, যেগুলো বাংলাদেশী হিসেবে দেখানো একজন নারীর মায়ের ও বাবার - উভয় দিকের পূর্বপুরুষদের। এই সব দলিল ১৯৫০, ১৯৬০ বা ১৯৭০-এর দশকের।
এই দুটি পরিবারের বিষয়ে প্রথমে দিল্লি হাইকোর্টে এবং পরে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন তাদের আত্মীয়রা।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন সামিরুল ইসলাম, যেখানে ওই দুটি পরিবারের সদস্যদের বর্ণনা করতে শোনা যাচ্ছে যে, তারা ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে দিল্লির পুলিশ তাদের বাংলাদেশি হিসেবে প্রত্যর্পণ করে দিয়েছে। তারা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কাতর আবেদন জানিয়েছেন যে, তাদের যাতে নিজের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
তারা অবশ্য বাংলাদেশের কোথায় আছে, তা নির্দিষ্ট করে জানা সম্ভব হয় নি। যে পরিবারের নথিসমূহ মুরারই থানার পুলিশ যোগাড় করেছে, তাদের সম্বন্ধে জানতে দিল্লি পুলিশের জনসংযোগ অফিসারকে ইমেল করেছে বিবিসি বাংলা। তবে এখনও তার কোনো জবাব আসেনি।
পুলিশের হাতে আটক, তারপরে বাংলাদেশে ------
বীরভূমের মুরারই থানা অঞ্চলের ধিতোরা গ্রামের বাসিন্দা আর্জিলা বিবি নামে এক নারী অভিযোগ জানিয়েছিলেন যে, তার পুত্রবধূ সুইটি বিবি ও দুই নাতি – ১৬ বছর বয়সী কুরবান শেখ ও ছয় বছরের ইমাম শেখকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের প্রধান আসিফ ফারুক বলছেন, সুইটি বিবি ও তার দুই পুত্র দিল্লিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন এবং পশ্চিম দিল্লির রোহিনী এলাকার কেএন কাটজু মার্গ থানা এদের আটক করে বাংলাদেশি সন্দেহে। এরপরে তাদের পশ্চিম দিল্লির এফআরআরও-র কাছে হাজির করা হয়।
এছাড়াও আরেকটি পরিবারের সদস্য সোনালি খাতুন, তার স্বামী দানেশ শেখ ও তাদের ছেলে সাবির শেখকেও একই সময়ে দিল্লির ওই একই থানা আটক করে। এরা পাইকর থানার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তাদেরও এফআরআরও বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে দেয়।
এফআরআরও-র নির্দেশনামায় লেখা হয়েছে যে, এই ছয়জনই 'বাংলাদেশি' এবং সেই দেশে এদের ঠিকানা বাগেরহাট জেলা।
কী ঘটেছিল পরিবার দুটির সঙ্গে? ---------
সোনালি খাতুনের ফুফাতো বোন রোশনি খাতুন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, "আমরা সবাই হলাম বীরভূম জেলার বাসিন্দা, আমাদের গ্রামগুলো পড়ে ওখানকার পাইকর আর মুরারই থানার ভেতরে। এখন থাকি দিল্লিতে রোহিণী ২৬ নম্বর সেক্টরের বাঙালি বস্তিতে।
"গত মাসে এই বস্তি থেকেই আমার বোন সোনালি, ওর স্বামী আর বাচ্চা ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। সোনালি চার মাসের গর্ভবতী, সেই অবস্থাতেই ধরে নিয়ে গেছে। আমরা থানায় গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছি, বলেছি ওদের কাগজপত্র দেখুন, ভেরিফাই করুন। কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ হয়নি।
সোনালির আর একটা মেয়ে আছে, সে এখন তার নানির কাছে পড়ে আছে। তারপর শুনলাম ওদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওরা ওখান থেকে দু'বার আমাদের ফোনও করেছিল, খুব কাঁদছিল। ভাল করে বলতেও পারলো না ঠিক কোথায় আছে! যাই জিজ্ঞেস করি খালি কাঁদতে থাকে," বলছিলেন রোশনি খাতুন।
আসিফ ফারুক বলছেন, "এই দুটি পরিবারকে গত মাসে দিল্লিতে তাদের বস্তি থেকে তুলে এনে বিমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের আগরতলায় পাঠানো হয় এবং তারপর সেখান থেকে ত্রিপুরা সীমান্তের কোনো জায়গা দিয়ে বিএসএফ তাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়।
"তবে দিল্লির অন্য কেসগুলোর সঙ্গে এটার একটা পার্থক্য আছে – এখানে দিল্লি পুলিশ এদের সরাসরি বিএসএফের হাতে তুলে দেয়নি, বরং এদের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরই অধীন এফআরআরও-র কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল" বলেন মি. ফারুক।
কী কী নথি যোগাড় হয়েছে? --------
বীরভূমের মুরারই থানা তাদের এলাকার তিনজন বাসিন্দার যেসব নথি যোগাড় করেছে, তার মধ্যে আছে এদের আধার কার্ড, সরকারী হাসপাতালে ইমাম শেখের জন্মের সার্টিফিকেট, তিনজনের নামে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের প্রশংসাপত্র, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিকের প্রশংসাপত্র ইত্যাদি।
এছাড়া সুইটি বিবির দাদু বাবু শেখের একটি জমির দলিলও পাওয়া যায়, যেটি রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল ১৯৬৬ সালে।
আবার ঝাড়খন্ডের পাকুর জেলায় সুইটি বিবির পূর্বপুরুষরা যেখানে থাকতেন, সেখানকার পঞ্চায়েত প্রধানের সই করা একটি বংশ তালিকাও যোগাড় করেছে বীরভূমের পুলিশ।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী শ্রমিক কল্যান পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম বুধবার তার এক্স হ্যান্ডেলে সুইটি বিবির দুই দাদু – জামিরুদ্দিন খান ও বাবু শেখের এবং সোনালি বিবির দাদুর বাবা মনখুস শেখের নামে থাকা জমির দলিল পোস্ট করেছেন। এই সব দলিল ৫০, ৬০ বা ৭০-এর দশকের।
ইসলাম ওই পোস্টে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ট্যাগ করে লিখেছেন, "যাদের বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ করা হয়েছে, তাদের নাগরিকত্ব মাঠ পর্যায়ে এসে যাচাই করার জন্য দয়া করে যত দ্রুত সম্ভব একটা সংসদীয় কমিটি গঠন করুন। সারা দেশ প্রমাণ দেখুক যে এই নারীরা বাংলাদেশের নয়, তারা ভারতেরই।
বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ভিডিও --------
যে দুটি পরিবারকে প্রত্যর্পন করা হয়েছে বাংলাদেশে, তাদের একটি ভিডিও এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেটি বাংলাদেশেই রেকর্ড করা হয়েছে, তবে নির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি যে ওই ভিডিওটি ঠিক কোন জায়গায় রেকর্ড করা।
ভিডিওটি সামিরুল ইসলাম পোস্ট করেছেন তার এক্স হ্যান্ডেলে। ওই ভিডিওতে দুজন নারী, দুটি শিশু, একজন কিশোর এবং আরও এক পুরুষকে দেখা যাচ্ছে।
সেখানে এক নারীকে দিল্লি পুলিশের হাতে আটক হওয়ার সময় থেকে ঘটনাক্রমের বর্ণনা দিতে শোনা যাচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের প্রধান আসিফ ফারুক দাবি করেন, ওই নারী সুইটি বিবি।
তিনি ওই ভিডিও বার্তায় বলেছেন, "আমাদের দিল্লি থেকে ধরেছে.. আমরা কাজ করতে গিয়েছিলাম। আধার কার্ড দেখালাম, আমরা বাংলাদেশি নই। তাও জবরদস্তি ওরা কী কী লিখিয়ে নিলে তোদেরকে বাংলাদেশি বানিয়ে দেবো," অভিযোগ করেন সুইটি বিবি।
তিনি এ-ও অভিযোগ করেন, প্রথমে রোহিনী অঞ্চলের থানায়, তারপরে একটি বাড়িতে চার দিন তাদের রাখা হয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যেই নানা কাগজপত্র বানানো হয়।
তার অভিযোগ, তাদের ছবি ও হাতের ছাপ নেওয়া হয়, হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে শারীরিক পরীক্ষাও করানো হয়। বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পরে তারা কার্যত এক কাপড়েই থাকছেন, মানুষের বাড়ির বারান্দায় মশার কামড় খেয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
ওই নারীর আবেদন, "অনুরোধ করছি আমাদের এখান থেকে নিয়ে যান মমতা দিদি।