একদিকে ধর্মীয় ঐতিহ্য, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী গর্ব আর ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব— এই তিনের মিশ্রণে দশকের পর দশক ধরে উত্তপ্ত হয়ে আছে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দুটি প্রতিবেশী দেশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একাদশ শতকে নির্মিত দুটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে এক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতের সৃষ্টি হয়, যেখানে প্রাণ হারান অন্তত ১৬ জন এবং প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। কিন্তু কী সেই কারণ, যার জন্য ৪.৬ বর্গকিলোমিটারের এক চিলতে জমি আর কয়েকটি প্রাচীন স্থাপত্য দুই দেশের সম্পর্ককে এতটা তিক্ত করে তুলেছে?
সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু: প্রিয়াহ ভিহিয়ার ও তা মন থম
এই সীমান্ত সংঘাতের মূলে রয়েছে দুটি বিখ্যাত খেমার মন্দির— প্রিয়াহ ভিহিয়ার (Preah Vihear) এবং তা মন থম (Ta Moan Thom)।
প্রিয়াহ ভিহিয়ার মন্দির: দাংরেক পর্বতমালার প্রায় ৫২৫ মিটার (১,৭২১ ফুট) উঁচু চূড়ায় অবস্থিত এই শিবমন্দিরটি খেমার স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদর্শন। একাদশ শতকে নির্মিত এই মন্দির থেকে নিচের সমভূমি অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। এর কৌশলগত অবস্থান এবং স্থাপত্যশৈলী এটিকে অনন্য করে তুলেছে।
তা মন থম: এটিও একটি প্রাচীন খেমার মন্দির কমপ্লেক্স এবং এই অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।
উভয় মন্দিরই হিন্দু দেবতা শিবকে উৎসর্গ করে নির্মিত হয়েছিল। যদিও বর্তমানে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া উভয় দেশই বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক শিকড় খেমার সাম্রাজ্যের হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত। ফলে এই মন্দিরগুলো শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, বরং দুই দেশের মানুষের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান এবং জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক।
বিরোধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ঔপনিবেশিক মানচিত্রের ত্রুটি
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত বিরোধের বীজ রোপিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলে।
খেমার সাম্রাজ্যের পতন: চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে খেমার সাম্রাজ্য আজকের থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনামের বিশাল অংশ শাসন করত। কিন্তু সাম্রাজ্যের পতনের পর থাই (তৎকালীন শ্যাম) ও ভিয়েতনামি শাসকরা ধীরে ধীরে খেমার ভূখণ্ড দখল করতে শুরু করে।
ফরাসি উপনিবেশ: ১৮৬৩ সালে ফ্রান্স কম্বোডিয়াকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করে। এরপর ফরাসি শাসকরা শ্যাম রাজ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে একাধিক চুক্তির মাধ্যমে বাতামবাং ও শ্যাম রিয়াপসহ (আঙ্কোর ওয়াট মন্দিরের নিকটবর্তী) বিভিন্ন ঐতিহাসিক খেমার অঞ্চল কম্বোডিয়ার অধীনে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য করে।
১৯০৭ সালের মানচিত্র: ১৯০৪-১৯০৭ সালের মধ্যে একটি ফরাসি-শ্যামদেশীয় কমিশন সীমান্ত নির্ধারণের জন্য একটি মানচিত্র তৈরি করে। সেই মানচিত্রে প্রিয়াহ ভিহিয়ার মন্দিরটিকে কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে দেখানো হয়। তৎকালীন শ্যাম সরকার সেই মানচিত্রে সম্মতি দিলেও পরবর্তীতে তারা এর বিরোধিতা করে। থাইল্যান্ডের দাবি, তারা ধরে নিয়েছিল যে সীমান্তটি পর্বতমালার প্রাকৃতিক জলবিভাজিকা (watershed line) অনুযায়ী নির্ধারিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের একটি সাধারণ নীতি। সেই নীতি মানা হলে মন্দিরটি থাইল্যান্ডের অংশে পড়ত। কিন্তু ফরাসিরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জলবিভাজিকা অনুসরণ না করে মানচিত্রটি তৈরি করে, যা শ্যাম সরকার দেরিতে বুঝতে পারে।
আন্তর্জাতিক আদালত এবং নতুন করে উত্তেজনা
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই বিরোধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছায়।
১৯৬২ সালের রায়: কম্বোডিয়া বিষয়টি হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (ICJ) নিয়ে যায়। ১৯৬২ সালে আদালত কম্বোডিয়ার পক্ষে রায় দেন। আদালত বলেন, থাইল্যান্ড যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ওই মানচিত্রটি নিয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি, সেহেতু এটি মেনে নিয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। ICJ থাইল্যান্ডকে মন্দির ও তার আশপাশের এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয় এবং ১৯৫৪ সালের পর সেখান থেকে সরানো সমস্ত প্রত্ন নিদর্শন ফেরত দিতে বলে।
২০০৮ সালের উত্তেজনা: থাইল্যান্ড অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেনা সরালেও মন্দিরের মালিকানা নিয়ে অসন্তোষ থেকেই যায়। ২০০৮ সালে কম্বোডিয়া প্রিয়াহ ভিহিয়ার মন্দিরকে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আবেদন করে এবং তা সফলভাবে গৃহীত হয়। এরপরেই থাইল্যান্ডে তীব্র রাজনৈতিক প্রতিবাদ শুরু হয় এবং দুই দেশের সীমান্তে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
২০১১ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘাত: এই উত্তেজনার জেরেই ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়, যা এক দশকের মধ্যে ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। এই সংঘাতে উভয় পক্ষের সেনা ও বেসামরিক নাগরিকসহ ১৬ জন নিহত হন এবং আহত হন শতাধিক।
২০১৩ সালের রায়: সংঘাতের পর কম্বোডিয়া পুনরায় ICJ-এর দ্বারস্থ হয়ে ১৯৬২ সালের রায়ের ব্যাখ্যা চায়। ২০১৩ সালে আদালত স্পষ্ট করে জানান যে, শুধু মন্দিরটিই নয়, মন্দিরের চারপাশের সম্পূর্ণ শৈলান্তরীপ (promontory) বা উঁচু ভূখণ্ডটিও কম্বোডিয়ার সার্বভৌমত্বের অধীন। আদালত আবারও থাইল্যান্ডকে ওই এলাকা থেকে তাদের সেনা, পুলিশ ও রক্ষীদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন।
বর্তমান পরিস্থিতি ও উপসংহার
আন্তর্জাতিক আদালতের রায় সত্ত্বেও থাইল্যান্ড এখনো পুরোপুরি সেই রায় মেনে নেয়নি এবং মন্দির সংলগ্ন এলাকায় তাদের সেনার উপস্থিতি বজায় রেখেছে। দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং যেকোনো সময় এটি নতুন করে সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির, যা দুটি দেশের مشترکہ ঐতিহ্যের অংশ হতে পারত, তাই আজ ঔপনিবেশিকতার রেখে যাওয়া ক্ষত, আধুনিক জাতীয়তাবাদ এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের এক জটিল প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এই বিরোধ প্রমাণ করে, কীভাবে ইতিহাসের অমীমাংসিত অধ্যায় বর্তমান ও भविष्यের শান্তিকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
তথ্যসূত্র:
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম (বিবিসি, রয়টার্স, আল জাজিরা)।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস (ICJ)-এর ১৯৬২ এবং ২০১৩ সালের রায়ের নথি।
ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের দস্তাবেজ।
ঐতিহাসিক দলিল এবং একাডেমিক গবেষণা।