দুই দশক আগের বুরাইদাহ শহর ছিল সৌদি আরবের রক্ষণশীলতার প্রতীক। তখন ধর্মীয় পুলিশ রাস্তায় টহল দিত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে দোকানপাট বন্ধ থাকত, নারীরা পুরুষ অভিভাবক ছাড়া ঘর থেকে বেরোতে পারতেন না, সিনেমা হল বা কনসার্ট ছিল না, আর বেশিরভাগ রেস্তোরাঁয় শুধু পুরুষদেরই প্রবেশাধিকার ছিল।
সেই সময়, তুলনামূলকভাবে কম তেলের দামের কারণে সরকারি চাকরিতে সহজ প্রবেশাধিকার নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। এর ফলেই সমাজে রক্ষণশীল সামাজিক চুক্তির ভাঙন ঘটে এবং জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। ২০০৫ সালে বুরাইদাহ শহরেই এক ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চলে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা।
আজকের বুরাইদাহ শহরের চিত্র একেবারে পাল্টে গেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় শহরের সড়কে এখন নারীরাও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করেন, যুগলরা একসঙ্গে রেস্তোরাঁয় খেতে যান, সিনেমা হলে চলে আরবি ও হলিউডি ছবি। ধর্মীয় পুলিশ নেই, সন্ত্রাসবাদের ভয়ও অতীত।
তবে এখন বুরাইদাহ শহরের বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থনীতির বৈচিত্র্যহীনতা। সরকারি চাকরির আধিপত্যে প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশ সীমিত, আর খেজুর চাষ নির্ভরশীল বিদেশি শ্রমিকদের ওপর।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) গত এক দশকে সমাজে কড়াকড়ি শিথিল করে ‘ভিশন ২০৩০’ নামে একটি বৃহৎ রূপান্তর প্রকল্প শুরু করেছেন। প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় রয়েছে নিওম নামের লিনিয়ার সিটি, মরুভূমিতে স্কি-গ্রাম, লোহিত সাগরের তীরে বিলাসবহুল হোটেল এবং রিয়াদে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন নির্মাণ।
সামাজিক সংস্কারে নারীদের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ থেকে নারীরা সহজে চলাফেরা, কাজ এবং ব্যবসার সুযোগ পাচ্ছেন। শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ ২০% থেকে বেড়ে ৩৬%-এ পৌঁছেছে, যার বড় অংশ উচ্চশিক্ষাহীন নারীদেরও।
গবেষণা বলছে, অনেক পুরুষ চাইতেন নারীরা কর্মজীবী হোক, কিন্তু সমাজকে রক্ষণশীল ভেবে তারা মুখ খুলতেন না। বাস্তবতা বলছে, সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতই ছিল।
সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি সৌদিতে বেড়েছে বিনোদন ও খেলাধুলার আয়োজন। জেদ্দায় ফর্মুলা ওয়ানের আগে মঞ্চে ওঠেন জেনিফার লোপেজ, রিয়াদের বুলেভার্ড সিটিতে ডিজের সুরে তরুণরা নাচে মেতে ওঠেন—যা এক সময় ছিল কল্পনার বাইরে।
২০১৭ সালে পরিবারের ব্যয়ের ১২ শতাংশ যেত খাবার, বিনোদন ও সংস্কৃতিতে, যা ২০২3 সালে বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বড় সাফল্য স্থানীয় পর্যটনে—২০১৬ সালে ৬ কোটি রাতযাপনকারী পর্যটক বেড়ে ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েছে ১০ কোটিতে।
তবে অর্থনৈতিক রূপান্তরের গতি এখনও ধীর। ২০১৬ সালে তেলখাত জিডিপির ৩৬% জুড়ে থাকলেও ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২৬%-এ। সরকার সৌরশক্তি, হাইড্রোজেন, খনি খাত, গাড়ি উৎপাদন ও আধুনিক প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, তবে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। যেমন, ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮০০টি বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখের তুলনায় অতি নগণ্য।
বিদেশি বিনিয়োগও ২০২৪ সালে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি, বৈদেশিক আস্থা ও নীতিগত স্থিতিশীলতা।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো ব্যয়বহুল গিগা-প্রকল্পগুলোর কারণে অন্যান্য কার্যকর ছোট প্রকল্প ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাংকগুলো সরকারকে বেশি ঋণ দিচ্ছে, ফলে প্রাইভেট খাতের ঋণপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি ঋণ জিডিপির ৩০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১৬ সালে ছিল মাত্র ১৩ শতাংশ।
স্মরণযোগ্য কিছু ঘটনাও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়েছে—যেমন ২০১৭ সালের 'রিটজ কার্লটন বন্দিত্ব', সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড। এসব ঘটনায় সৌদি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অনেক প্রকল্প এখন ছোট করা হচ্ছে বা কেবল ‘প্রুফ অব কনসেপ্ট’ হিসেবে রাখা হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি বেড়েছে, বাণিজ্য ঘাটতিও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সৌদির অর্থনৈতিক পরিবর্তনের গতি যতোটা দ্রুত প্রয়োজন, তা হয়নি। সরকারকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমিয়ে বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার সুযোগ দিতে হবে। সাহসী শিক্ষা সংস্কার এবং বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্য নির্ধারণও জরুরি।
সৌদি আরব সামাজিক বিপ্লবে এগিয়ে গেলেও অর্থনৈতিক রূপান্তরের জন্য আরও সময়, ধৈর্য, দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। পরিবর্তনের এ যাত্রা কি এমবিএস-এর একক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরই নির্ভর করবে, নাকি একটি সুসংগঠিত ও টেকসই রূপান্তরের দিকে এগোবে দেশটি—এ প্রশ্নই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। উৎস: দ্য ইকোনমিস্ট