বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে কেনাকাটার নামে চলছে এক ভয়াবহ দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের মহোৎসব। বাজারমূল্যের চেয়ে ৬ থেকে ৭ গুণ বেশি দামে পণ্য কিনে বিল পরিশোধ করা হচ্ছে অস্তিত্বহীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে। টয়লেট ক্লিনার, ঝাড়ু থেকে শুরু করে প্রিন্টারের টোনার পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারি অর্থ লোপাটের এই চাঞ্চল্যকর চিত্র উঠে এসেছে যমুনা টেলিভিশনের এক বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেলের পশ্চিমাঞ্চল ট্রেনের পরিচ্ছন্নতার জন্য টয়লেট ক্লিনার ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে বিল করেছে প্রায় ২১ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু ট্রেন ধোয়ার ব্রাশ, ডিটারজেন্ট ও ন্যাকরা কিনতেই খরচ দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অথচ এসব পণ্যের প্রকৃত বাজারমূল্য অনেক কম।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, "মেসার্স সারোয়ার এন্টারপ্রাইজ" নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে এই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু कागজে উল্লেখিত রাজশাহীর আর.ডি.এ মার্কেটের ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই নেই, বরং সেটি একটি মসলার দোকান। দোকানের মালিক জানান, বহু বছর ধরে তারা সেখানে ব্যবসা করলেও এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানকে তারা চেনেন না। একইভাবে, স্টিলের র্যাক সরবরাহের জন্য "আবিদ ট্রেডার্স" নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল দেখানো হলেও বাস্তবে সেই প্রতিষ্ঠানেরও কোনো খোঁজ মেলেনি।
দুর্নীতির সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায় প্রিন্টার টোনার কেনার ক্ষেত্রে। বাজারে যে টোনারের দাম সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, রেলওয়ে সেই একই টোনার কিনেছে প্রতিটি ৫,১৯০ টাকায়, যা বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি।
এই অনিয়ম সম্প্রতি প্রকাশিত ২০২০-২১ অর্থবছরের একটি অডিট রিপোর্টেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, মাত্র ৩,০০০ টাকার একটি সিসি ক্যামেরা কেনা হয়েছে ২২,৫০০ টাকায় এবং ৬১,০০০ টাকার ফটোকপি মেশিনের বিল করা হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অডিট রিপোর্ট বলছে, ওই এক বছরেই চাহিদার বাইরে প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ টাকার অতিরিক্ত মালামাল কেনা হয়েছে, যা সরাসরি সরকারি অর্থের অপচয়।
এসব অভিযোগের বিষয়ে রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এবং সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দায়সারা জবাব দিয়েছেন। তারা পণ্যের গুণগত মান এবং "অরিজিনাল" ও "ডুপ্লিকেট" পণ্যের দোহাই দিয়ে এই আকাশছোঁয়া দামকে বৈধ করার চেষ্টা করেন। এমনকি একজন কর্মকর্তা উল্টো অডিট রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি একটি সংঘবদ্ধ দুর্নীতির চিত্র। বছরের পর বছর ধরে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে বিল করে এবং পণ্যের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে একটি চক্র সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে চলেছে। অতীতে অনিয়মের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের সম্পদ রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদ্ধতিগত সংস্কার এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই বলে তারা মনে করেন।