আলী আকবর। একসময় ছিল স্বল্প শিক্ষিত একজন বেকার তরুণ। বসবাস করতো নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন চালিতাতলী পূর্ব মসজিদ এলাকায়। তার বাবা মঞ্জু মিয়া ছিলেন খেটে খাওয়া মানুষ। সেও দৈনিকভিত্তিক মজুর ছিলেন। তবে সেই কাজে তার মন বসেনি। কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দিয়ে শুরু করে ছোটখাটো অপরাধ। পরে তার সাহস ও দুর্ধর্ষতা দেখে তাকে দলে ভেড়ায় বিদেশ পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী আলোচিত এইট মার্ডার মামলার প্রধান আসামি সাজ্জাদ আলী খান। এরপর থেকে তারই নির্দেশে বায়েজিদ, অক্সিজেন, হাটহাজারী, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, কর্ণফুলি নদীসহ নগরীর নানা স্থানে চাঁদাবাজি শুরু করে আকবর। হাতে তুলে নেয় দেশি-বিদেশি অস্ত্র। অপরাধ জগতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আকবর ঝুঁকে পড়ে নারী ও মদের নেশায়। একসময় ঢাকার এক মেয়েকে বিয়ে করে আলী আকবর হয়ে যান ঢাকাইয়া আকবর। আর সেই নামেই স্বস্তিবোধ করতো সে।
নাম শুনতে যেমন ভয়ঙ্কর, কাজ ছিল আরও ভয়ঙ্কর। হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, গুলি ছোড়া, অস্ত্রের ঝনঝনানি, আগুন দিয়ে বাড়ি-দোকান জ্বালিয়ে দেয়া তার কাছে ছিল মামুলি ব্যাপার। প্রায় ১ যুগ আগে সাজ্জাদ আলী খানের হাত ধরে আন্ডারওয়ার্ল্ডে পা রাখলেও ধীর ধীরে এই জগতে আলোচিত হয়ে ওঠে ঢাকাইয়া আকবর। সিএমপিও তাকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। তবে শেষমেশ নারীতেই পতন হলো এই সন্ত্রাসীর। রোববার চমেক হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এর আগে শুক্রবার রাত আটটার দিকে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে তাকে এলোপাতাড়ি গুলি করা হয়। তার শরীরে অন্তত ১০-১২টি গুলি লাগে। এসময় গুলিবিদ্ধ হন ৮ বছরের শিশু রাতুলসহ আরও এক দর্শনার্থী। তবে অনেকে মনে করছেন, ঢাকাইয়া আকবরের মৃত্যু আন্ডারওয়ার্ল্ডে আরও অশান্তি সৃষ্টি করবে নতুন করে।
সূত্র মতে, ফেসবুকে বেশ সক্রিয় আকবর। তার আইডিও ভেরিফাইড। প্রায় সময় সে নানারকম ভিডিওর পাশাপাশি আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্নাকে কটূক্তি করে ভিডিও পোস্ট করতো। নগরে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুই ডন সরোয়ার বাবলা ও বিদেশে পলাতক সাজ্জাদ আলী খানের সঙ্গে চাঁদাবাজি ও ব্যবসাকে ঘিরে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঝামেলা চলছিল। সেই বিরোধে জড়িয়ে ছিল তাদের শিষ্যরা। ঢাকাইয়া আকবর একসময় সাজ্জাদ আলী খানের শিষ্য থাকলেও ৩ বছর আগে থেকে তার দল ছাড়ে। পরে যোগ দেয় তারই প্রতিপক্ষ সরোয়ার বাবলার সঙ্গে। গত ১৫ই মার্চ ছোট সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হলে এই দু’গ্রপের উত্তেজনা আরও বাড়ে। ২৯শে মার্চ নগরের বাকলিয়ায় ব্যাপক গোলাগুলিতে ডাবল মার্ডার হয়। এরপরই ঘটে ঢাকাইয়া আকবরের ঘটনা। সরোয়ার বাবলার গ্রুপের লোকজন বলছে, এসব ঘটাচ্ছে ছোট সাজ্জাদের বাহিনী। একের পর এক টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে তারা হত্যা করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ‘সন্ত্রাসী’ আকবরের পরনারীর প্রতি দুর্বলতা ছিল আগে থেকেই। তাই তাকে ‘হত্যাচেষ্টা মিশনে’ পাতা হয়েছিল তরুণীর ফাঁদ। যার সঙ্গে মাত্র পাঁচদিনের পরিচয়ে ‘ডেটিংয়ে’ গিয়েছিলেন আকবর। এদিকে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র বলছে, এই হামলার নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন বড় সাজ্জাদ। ২০২৩ সালের দিকে কারাবন্দি অবস্থায় আকবরকে জামিন না করানোয় সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয় গুরু ও শিষ্যের। সেই থেকেই আকবরের ওপর ক্ষোভ থাকলেও সামপ্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে তা আরও বেড়ে যায়। পতেঙ্গা সৈকতে গোলাগুলির নেপথ্যে ছিল সেই দ্বন্দ্ব। প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যবসায়ী বলেন, আকবরের সঙ্গে থাকা চারজন ছেলেসহ তারা ৬-৭ জন সৈকতের ২৮ নম্বর দোকানে বসেছিলেন।
মোটরসাইকেলে করে ৪ জন যুবক ঘটনাস্থলে এসে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। এরপর আকবরের সঙ্গে থাকা ৪ জন সেখান থেকে দৌড়ে পালায়। আর যে তরুণী ছিলেন তিনি গুলিবর্ষণকারীদের সঙ্গে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। আকবরকে গুলির পরপরই স্থানীয়রা সেখানে জড়ো হন। তার শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। এরপর তাকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। হাসপাতালে নেয়ার আগে আকবর কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে, এই হামলার পেছনে রায়হান, খোরশেদ, ইমন ও বোরহান দায়ী। তারাই তাকে গুলি করেছে। ওই তরুণীর সঙ্গেও তার প্রথম দেখা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ওই চারজন ছাড়াও সেগুন এবং মোহাম্মদ নামে আরও দু’জন ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন। বাকি চারজনসহ এই ছয়জন চট্টগ্রামের আলোচিত এইট মার্ডার মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের অনুসারী। গুলিবিদ্ধ আকবরের বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন সময় এসব মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হলেও জামিনে ছাড়া পেয়ে যান। ঢাকাইয়া আকবর ২০২৩ সালে গুরু সাজ্জাদ আলী খানের ভাইয়ের কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। পরে না পেয়ে সাজ্জাদ আলী খানের বাড়ি গানপাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তার সঙ্গে থাকতে ঢাকাইয়া আকবর চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে ‘নিয়মিত চাঁদাবাজি’ করতেন। সাজ্জাদের ‘ সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ হিসেবে কাজ করতেন ঢাকাইয়া আকবর। ২০১৭ সালে আকবরকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। সে সময় ছয় রাউন্ড কার্তুজসহ একটি বন্দুক উদ্ধার করা হয় তার কাছ থেকে। এরপর দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলেন আকবর। দু’বছর কারাভোগের পর ২০২২ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর জামিনে ছাড়া পান তিনি। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর থেকে দু’টি অস্ত্রসহ তাকে আবারো গ্রেপ্তার করে বায়েজিদ থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভবন মালিককে ফোন করে চাঁদা দাবির অভিযোগ ছিল সে সময়।
আকবরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০২৩ সালে গ্রেপ্তারের পর জেলে থাকা অবস্থায় আকবর ভেবেছিলেন ‘গুরু’ সাজ্জাদ আলী খান তার জামিনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু ‘গুরুর’ সেই ‘আশীর্বাদের হাত’ পায়নি সে। তার পরিবারই অনেক কষ্টে জোগাড় করেছে মামলা পরিচালনার ব্যয়। তখন থেকেই গুরুর ওপর ক্ষোভ জন্মে তার। জামিনে বেরিয়ে আকবর গুরুকে টেক্কা দিতে নিজেই গড়ে তোলেন বাহিনী। এরপর থেকেই বড় সাজ্জাদের চাঁদাবাজিসহ নানা কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সে। পুলিশকে সাজ্জাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়েও সাহায্য করতো সে।
তাই আকবরের প্রতি সমপ্রতি বেশ ক্ষুব্ধ হয় বড় সাজ্জাদ। আকবরের ফেসবুক আইডি ঘেঁটে দেখা গেছে, কারাবন্দি ছোট সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্না শারমিনকে নিয়ে প্রায়ই ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও পোস্ট করতো সে। এ ছাড়া পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান এবং বিএনপি’র এক শীর্ষ নেতাকে হুমকি দিয়েও ভিডিও পোস্ট করতে দেখা গেছে। সমপ্রতি গ্রেপ্তার হওয়া শীর্ষ এই সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দিতে পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন আকবর- এমন গুঞ্জন আছে। হাসপাতালে আকবরের স্বজনদেরও দাবি, এই ঘটনায় কারাগারে বন্দি ‘সন্ত্রাসী’ ছোট সাজ্জাদের অনুসারীরা জড়িত। উৎস: মানবজমিন।