এস এম সালাহউদ্দিন, (আনোয়ারা,কর্ণফুলী) সংবাদদাতা : চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) আবারো নির্বিচারে পাহাড় কেটে সাবাড় করছে। কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে গত ১ মে খেলতে গিয়ে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে ২ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়। পূর্বে পাহাড় কাটা বন্ধ করতে কেইপিজেডকে হাইকোর্ট নির্দেশনাও দেন। কিন্তু সময় ও সুযোগ বুঝে তারা আবারো কখনো রাতে আবার কখনো দিনে পাহাড় কাটছে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। পাহাড়ে বসবাসরত বণ্যপ্রাণীরা চলে আসছে লোকালয়ে, নষ্ট করছে জমির ফসল।
পাহাড় কাটার কারণে বিগত ৮ বছরে পাহাড় থেকে লোকালয়ে নেমে এসে বন্য হাতির আক্রমণে আনোয়ারা কর্ণফুলীতে ১৯ জন নারী-শিশু ও বৃদ্ধা নিহত হয়েছে। সরেজমিনে সোমবার গিয়ে দেখা যায়, পাহাড় কাটার আশেপাশে কাউকে যেতে দিচ্ছে না। কড়া সিকিউরিটি গার্ডের পাহাড়ায় আনোয়ারা বৈরাগের দক্ষিণ ব্লকে এস্কেভেটর দিয়ে উঁচু পাহাড় কেটে মাটি অপসারণ করে সমতল করা হচ্ছে। এতে করে বিলুপ্তির পথে এখন দেয়াং পাহাড়। বাকি যে টিলা-পাহাড়গুলো রয়েছে সেগুলো কেটে মাটি একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে কারখানা, ইমারত ও রাস্তা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ১ মে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে ২ জন নিহত ও ২ জন আহত হওয়ার পর এতদিন পাহাড় কাটার কাজ বন্ধ ছিলো। গত শনিবার থেকে আবার পুরোদমে কেইপিজেড পাহাড় কাটা শুরু করেছে।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ বেসরকারী ইপিজেড আইনে দেশের প্রথম ব্যক্তি মালিকানায় চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলার দেয়াং পাহাড়ে ২ হাজার ৪৯২ একর জমির উপর কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াংওয়ান কপোর্রেশন কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) স্থাপন করে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেন। সরকারের সাথে তাদের চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ে সবুজায়নসহ যেখানে যে অবস্থায় আছে সেভাবেই কারখানা নির্মাণ করতে হবে। কোন ভাবেই পাহাড় কাটা যাবেনা। কিন্তু কেইপিজেড বিভিন্ন সময় পাহাড় কাটা শুরু করলে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে পাহাড় কাটা বন্ধসহ জরিমানা করেন তাদের।
২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর এক চিঠিতে আদালত কেইপিজেডকে পাহাড় ড্রেসিংয়ের অনুমতি দেয়। তবে পাহাড় কেটে বিলুপ্ত করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এমনকি পাহাড়-টিলা কাটার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানাতে হবে বলেও নির্দেশনা দেন আদালত। কিন্তু এসবের কিছুই তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সময় নির্বিচারে তাঁরা পাহাড় কাটছে। এসব নির্দেশ অমান্য করায় হাইকোর্ট পাহাড় কাটা বন্ধ রাখার জন্যও নির্দেশ দেন। ২০১২ সালে পাহাড় কাটার অভিযোগে কেইপিজেডের তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাও করেন পরিবেশ অধিদপ্তর। কেইপিজেডকে দেওয়া শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মানুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে ৩৩ শতাংশ জমিতে বনায়ন, ১৯ শতাংশ জমি জলাধার ও খালি জায়গার জন্য রাখতে হবে। ফলে কারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামোর জন্য জমি থাকবে এক হাজার ২০০ একরের মতো। এ জমির আবার ৩০ শতাংশ (৩৬০ একর) রাস্তা, পরিসেবা ও আনুষঙ্গিক সহযোগী অবকাঠামোর জন্য ব্যয় হবে। অর্থাৎ কারখানা করা যাবে সর্বসাকুল্যে ৮৪০ একর জমিতে। এসব শর্ত না মানায় বিগত আওয়ামীলীগ সরকার কেইপিজেডকে ৫০০ একর জমির মালিকানা দিয়ে বাকি জমি ফেরত নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। এরপর তারা নতুন নতুন কারখানা স্থাপন শুরু করেন।
সম্প্রতি অন্তবর্তী সরকার কেইপিজেডকে জমির মালিকানা বুঝিয়ে দেন এবং কেইপিজেডের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে সম্মাননা হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, কেইপিজেড পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়েই কাটছে। এগুলো পাহাড় না, টিলা। টিলা সমতল করা হচ্ছে। পাহাড় কাটার অনুমতির বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. মঈনুদ্দিন ফায়সালের কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে, তিনি কেইপিজেডের নাম শুনে ব্যস্ত আছে বলে ফোন কেটে দেন। আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন আছে কিনা আমরা যাচাই-বাচাই করে দেখবো।