শিরোনাম
◈ শ্রমিকের পাওনা শোধ না করলে মালিকদের জেলে যেতে হবে: উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন (ভিডিও) ◈ আছিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যা: হিটু শেখের ডেথ রেফারেন্সের নথি হাইকোর্টে ◈ নাটোরে আম পাড়া নিয়ে বিএনপির দুই গ্রুপের রক্তাক্ত সংঘর্ষ, গুলিবর্ষণ (ভিডিও) ◈ সমর্থকদের রাজপথ না ছাড়ার নির্দেশ ইশরাকের ◈ জমি-ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন খরচে বড় ছাড়: বাজারমূল্যে দলিল বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ ◈ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে, অপেক্ষা সরকারের সবুজ সংকেতের ◈ মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথ না পড়ানো নিয়ে রিটের আদেশ আগামীকাল বৃহস্পতিবার ◈ সিরাজগঞ্জে হামলার আতঙ্কে গ্রাম ছাড়ছে মানুষ, সরিয়ে নিচ্ছে আসবাবও (ভিডিও) ◈ সেনাপ্রধানকে নিয়ে ’পিওর গুজব ছড়ানো হচ্ছে’, এই ধরনের তথ্য ছড়াচ্ছে, তারা দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে চায় : প্রেস সচিব ◈ বিদেশি অপারেটরকে টার্মিনাল? রাজনৈতিক মহলে তুমুল বিরোধিতা

প্রকাশিত : ২১ মে, ২০২৫, ১০:৩৮ দুপুর
আপডেট : ২১ মে, ২০২৫, ০৪:০০ দুপুর

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

একটা গুলি আমাগো জীবন তছনছ কইরা দিলো, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ আরমানের ছেলে-মেয়ের ঠাঁই হলো এতিমখানায়

আরমান মোল্লা ছিলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কলাগাছিয়া নয়াপাড়ার এলাকার বাসিন্দা। ২০২৪ সালের ২১ জুলাই নরসিংদী শিলমান্দী ইউনিয়নের সামনে আন্দোলনরত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। আর তার মৃত্যুতে নাবালক তিন অবুঝ সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্ত্রী সালমা বেগম।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে রাজপথে মারা যাওয়া আরমান মোল্লা ওরফে নাহিদের স্ত্রী সালমা বেগম বলেন, ‘আমার জামাই ঝালমুড়ি বেচত, ঘরে টাকা-পয়সা কম ছিল ঠিক। কিন্তু সুখের কোনো কমতি ছিল না। একটা গুলি আমাগো জীবন তছনছ কইরা দিলো। ভালা মানুষ জামাইডা দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়া গুলি খাইয়া মইরা গেল। এখন আমার আর চলার মতোন অবস্থা নাই। এল্লিগা, কোনো উপায় না দেইখা বড় মাইয়া আর একমাত্র পোলাডারে এতিমখানায় দিয়া সাইরা আমি এহন বুকে পাত্থর বাইন্ধা মরার মতোন ঘরে পইরা রইছি।’

স্বামীর সঙ্গে শেষ স্মৃতির ব্যাপারে আরমান মোল্লার স্ত্রী সালমা বেগম বলেন, ঘটনার দিন সকালে আমি উইঠা রুটি বানাইয়া সাইরা ভাজি রানছিলাম। ওয় (আরমান মোল্লা) রুটি খাইয়া কয়, আজকার ভাজিডা খুব মজা অইছে। এমনেই বানাইয়ো। এরপর আমারে কয়, তুমি রান্নাডা সাইরালাও। আমি কাপড় ধুইয়া দিতাছি।

তিনি বলেন, আমার কোমরে ব্যথা হওয়ার পর থিকা হেয় আমারে কোনো উডাইন্না কাম (ভারী কিছু ওঠানোর কাজ) করতে দিতো না। আমার আর পোলাপানের সব কাপড় হেয়ই ধুইয়া দিতো। বাচ্চাগো আর আমার অনেক আদর-যত্ন করতো। হের মতোন ভালা মানুষ দুনিয়ায় কমই আছে।

সালমা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আন্দোলনে যাইব দেইখা আমারে কইল, আজকা ভাল্লাগতাছে না। আজকা মুড়ি বেচত যাইত না। এরমইধ্যে হের এক বন্ধু ডাক দিলে হেয় বাইরে যাওয়ার কথা কয়। শরীর ভালা না দেইখা আমি যাইতে বারবার কইরা না করছি। কিন্তু হেয় আমার কোনো কথা শুনে নাই। তবে মুখে খালি কইছিল, একটু ঘুরে আসি।

তিনি বলেন, আমি পরে হের বন্ধুরথে শুনছি, হেয় আন্দোলনে যাওনের লাগিই বাইর অইছিল। ওয় যদি হেইদিন আমার কথাডা শুনত! এরপর আর কিছু না বলে দু’চোখের পানি ছেড়ে কান্না করতে থাকেন আরমান মোল্লার স্ত্রী।

সালমা বেগম স্বামীর মৃত্যুর বর্ণনাও দেন। সেই দুপুরের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, দুপুরের খাওনের সময় গেলেও ওয় বাইত ঢুকে না। পরে আমি ফোন দিছি, ফোন ধরছে হের বন্ধু। ওই ভাইয়ে কয়, ভাবি নাহিদের (আরমান মোল্লা) গুলি লাগছে। আপনে হাসপাতলে আসেন। কথা শুইনা ছোড মাইয়ারে লইয়া নরসিংদী সদর হাসপাতালে গিয়া দেখি, হের মুখের উপরে কাপড় দিয়া ঢাইকা রাখছে। আমার জামাই হাসপাতালে আনার আগেই দম ফালায় দিছে।

নরসিংদীতে প্রথম জানাজা দিয়ে আরমান মোল্লাকে রাতে আড়াইহাজার কলাগাছিয়া নয়াপাড়া তার বাবার বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নোয়াপাড়ায় স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।

আরমান মোল্লার তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে মাহি (১০) ও রাফি (৭) কিছু দিন থেকে একটি এতিমখানায় থাকে। অর্থাভাবে তাদের এতিমখানায় দিতে বাধ্য হয়েছেন মা সালমা বেগম। ছোট মেয়ে আফরামনির বয়স এখন তিন চলছে। আফরামনি মাত্র দুই বছর বয়সেই তার বাবাকে হারায়। কিন্তু বাবার স্মৃতি তার চোখে এখনও সজীব, সতেজ। এমনকি মাঝে মাঝে আফরা তার বাবাকে স্বপ্নে দেখে বলেও জানান তার মা।

সালমা বেগম বলেন, সবাই ভুইলা গেলেও আমার ছোট মাইয়াডা তার বাপেরে ভুলতে পারে নাই। ঘুমের ভিত্রেও বাপরে ডাকে। বাপেরে স্বপ্ন দেইখা বাস্তবে দেখছে মনে কইরা বইলা ওঠে, ‘আব্বু জামা ময়লা, জামা খুলো।’ আমার বুকডা ফাইট্টা যাইতে চায়।

আরমান মোল্লা যখন সারাদিন ঝালমুড়ি বিক্রি করে ঘর্মাক্ত হয়ে ময়লা কাপড়ে বাসায় ফিরতেন, তখন বাবাকে কাপড় খুলতে বলত ছোট্ট আফরা। তাকে জড়িয়ে ধরে মজা খাওয়ার আবদার করত। সেই স্মৃতি এখনও তার শিশুমনে জ্বলজ্যান্ত হয়ে গেঁথে আছে বলে জানান সালমা বেগম। তিনি বলেন, সকালে ওর আব্বু ওরে ডাক দিয়া উঠাইত। হের লিগা ওর মরণের পর অনেকদিন সকালে ঘুম থিকা উঠলেই আফরা বাপেরে খুঁজত, আর না পাইয়া কানত। এখনও রাইত অইলে কয়, ‘মা, আব্বুরে কেক নিয়া আইতে কও, আব্বু আইলেই ঘুমামু।’

আরমান মোল্লা ছিলেন পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুর পর পরিবারে চরম সংকট পড়েছে। তার পুরো পরিবার এখন তার অসুস্থ শ্বশুরের ওপর নির্ভরশীল। তিন সন্তান নিয়ে সালমা তার বাবা মীর আলীর সঙ্গে বসবাস করছিলেন। সংসারের খরচ মেটাতে না পেরে বড় মেয়ে ও ছেলেকে এতিমখানায় দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

সালমা বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আব্বার পক্ষে আমাগো সবার খরচ দেয়া সম্ভব নাহ। এল্লিগা মাইয়া আর পোলাডারে এতিমখানায় দিয়া দিছি। অসহায়ভাবে তিনি আরও বলেন, আমার কোমরের হাড় ক্ষয় হওয়ার পর থেকে আমার জামাই ঘরের কাম-কাইজ করতে আমারে সাহায্য করতো। আমি এই শইল লইয়া এহন ক্যামনে বাইরে কাম করমু? কোমরের লিগা আমি ঘরের কাইজ-কাম বেশি করতে পারি না। আমার কোমরের ব্যথার জন্য মাসে ৮০০ টাকার অষুধ লাগে। পেটে ঠিকমত ভাতই জুটে না, অষুধ খামু কই থিকা। কোমরের ব্যথায় আমি মাঝেমধ্যে বিছানা থেইকা উঠতে পারি না। আমার স্বামী ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই।

এদিকে এখনো সরকার থেকে এখনও কোনো সহায়তা পাননি জানিয়ে সালমা বেগম বলেন, সরকার থেকে লাখ লাখ টাকা দিছে শুনছি। কিন্তু আমি কোনো টাকা পাইনি। টাকার চেক পাইছে আমার শ্বশুর বাড়ির মানুষরা। তারা আমাকে এক টাকাও দিবে না বইলা জানায় দিছে।

অভিমানভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার স্বামী বেঁচে থাকতে তাগো লগে সম্পর্ক ভালাই আছিল। এহন আমার স্বামীও নাই, তারাও আমার উপ্রে জুলুম করা শুরু করছে। আমার পোলাপানের মুখের দিকেও চাইল না হেরা। আমি সরকারের কাছে, সবার কাছে সাহায্য চাই। আমারে একটু সাহায্য করেন, যাতে আমি আমার স্বামী আরমান মোল্লার রেখে যাওয়া পোলাপানগুলারে আমার কাছে রাইখা মানুষ করতে পারি।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহিদুল ইসলাম সালমা বেগম ও তার সন্তানদের সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের বীর সন্তানরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গৌরব। তাদের সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও অদম্য চেতনা আমাদের জাতি পুনর্গঠনের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তাদের পরিবারের সদস্যরা আর্থিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত হবে না। বিষয়টি খতিয়ে দেখে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে জানতে চাইলে সালমা বেগম বলেন, আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। খুনিদের শাস্তি চাই। আমার জামাইয়ের মৃত্যুর পর আমাদের সংসারটা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি বাসায় থাকি, আমার মাইয়া-পোলা থাকে এতিমখানায়।

প্রসঙ্গত, সরকার প্রকাশিত গেজেটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদের তালিকায় আরমান মোল্লার নাম ৪৪১ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়