হ্যাপী আক্তার: থ্যালাসেমিয়া মূলত একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এসব রোগী ছোট বয়স থেকেই রক্তস্বল্পতায় ভোগে। অর্থাৎ অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগে রক্তে হিমোগ্লোবিন কণা উৎপাদনে সমস্যা হয়। তাই আক্রান্তদের শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত তৈরি করতে পারে না, তাই অন্যের রক্ত ট্রান্সফিউশন নিয়ে তাদের জীবন চালাতে হয়।
১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি চিহ্নিত করেন। থ্যালাসেমিয়া অটোজোমাল মিউট্যান্ট প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রক্তের রোগ। মা-বাবার কাছ থেকে সন্তানের শরীরে আসে।
বাহকের নিজের তেমন কোন শারীরিক সমস্যা থাকে না। তাই বাহক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব থাকে। অথচ রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রফরেসিস পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই নির্ণয় করা যায়।
থ্যালাসেমিয়া রোগটি প্রধানত দুই প্রকার। মেজর ও মাইনর। বাহকরা মাইনর থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্ম নিলে সেটি মেজর থ্যালাসেমিয়া। এর বাইরে আছে আলফা ও বিটা। আলফা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি। বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা অনেক বেশি।
থ্যালাসেমিয়া মেজর কুলিস অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত সন্তান সাধারণত ৩০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। মা ও বাবা কিংবা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জিন থেকে ভূমিষ্ঠ শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়, শতকরা ২৫ ভাগ সুস্থ হয়ে জন্মগ্রহণ করে, শতকরা ৫০ ভাগ রোগী বাহক হিসেবে জন্ম নেয়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই জানা যায় থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না। একজন বাহক এবং অপরজন সুস্থ এমন দুজনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে সন্তানদের কোনো সমস্যা হবে না।
এটি ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলো যেমন— মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলোয় এ সমস্যা বেশি থাকলেও গ্লোবালাইজেশনের কারণে এখন পৃথিবীর সব দেশেই এ রোগী পাওয়া যায়।
থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গ থ্যালাসেমিয়া রোগের ধরনের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। বিটা থ্যালাসেমিয়া এবং কিছু ধরনের আলফা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বেশিরভাগ শিশুর মধ্যে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তবে এর পরে বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে
দেখে নেওয়া যাক থ্যালাসেমিয়া হলে কী কী লক্ষণ দেখা দিতে পারে:
** জন্ডিস ও ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণে শিশুদের জন্ডিস হতে পারে এবং তাদের ত্বক ফ্যাকাশে দেখাতে পারে।
** থ্যালাসেমিয়া হলে অনেক বেশি পরিমাণে তন্দ্রা লেগে থাকা ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
** থ্যালাসেমিয়ার কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে।
** হাত পা ঠণ্ডা হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
** নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
** থ্যালাসেমিয়ার কারণে পায়ে ক্রাম্প হতে পারে।
** থ্যালাসেমিয়া হলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
** অনেক সময় থ্যালাসেমিয়া হলে শিশুরা আর খেতে চায় না বা খাবারে অনীহা দেখা দিতে পারে।
** থ্যালাসেমিয়ার কারণে শিশুদের বৃদ্ধিতে বিলম্ব দেখা দিতে পারে বা শিশুরা ঠিক মতো বেড়ে ওঠে না।
** অনেক সময় মাথাব্যথা দেখা দিতে পারে।
** মাথা ঘোরা ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
** ইনফেকশন বা সংক্রমণে সহজেই প্রভাবিত হওয়া এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
দেখে নেওয়া যাক প্রতিরোধের উপায়: একটু সচেতন হলেই আমরা এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে, যেমন—সাইপ্রাস ১৯৭৩ সালে, বাহরাইন ১৯৮৫, ইরান ২০০৪, সৌদি আরব ২০০৪ এবং সর্বশেষ পাকিস্তান ২০১৩ সালে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়া আছে কি না তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে থ্যালাসেমিয়া রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। সূত্র: বার্তা২৪, একুশে টিভি