সহযোগীদের খবর: বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান। দেশের মোট আবাদি জমির প্রায় তিন-চতুর্থাংশেই এ ফসলের চাষ হয়। তবে সেচ, শ্রমিক, সার ও কীটনাশকসহ প্রায় সব ধরনের কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্যের কারণে ধান উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় ক্রমেই বেড়েছে। বিপরীতে যে মুনাফা পাওয়া যায়, তা অত্যন্ত সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে বৈরী আবহাওয়া বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষককে মূলধন হারানোর ঝুঁকিও নিতে হয়। ফলে ধান চাষ কৃষকের জীবনমানে খুব একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে না। এ বাস্তবতায় অনেক কৃষক ভুট্টা, ডাল, সরিষা ও বিভিন্ন বিদেশী ফলসহ তুলনামূলক লাভজনক ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। সূত্র: বণিক বার্তা প্রতিবেদন
কৃষিসংশ্লিষ্টদের মতে, ভুট্টা, গম, মসুর, পেঁয়াজ ও রসুনের তুলনায় বর্তমানে ধানই কৃষকের জন্য সবচেয়ে কম মুনাফার ফসল। খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে তারা ধান চাষ চালিয়ে গেলেও আর্থিকভাবে লাভবান না হওয়ায় দিন দিনই আগ্রহ কমছে। এ অবস্থায় প্রধান এ খাদ্যশস্য চাষে কৃষককে ধরে রাখতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাড়ানোর পাশাপাশি নীতিগত সহায়তা জরুরি। অন্যথায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তাই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক কেজি রোপা বোরো (হাইব্রিড) ধান উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় হয়েছে ২৪ টাকা ৩১ পয়সা। বিপরীতে তা বিক্রি করেছেন ২৭ টাকা ৪৯ পয়সা দরে। অর্থাৎ এক মণ ধান উৎপাদনে যেখানে ব্যয় হয়েছে ৯৭২ টাকা, সেখানে বিক্রি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১০০ টাকায়। অন্যদিকে বিকল্প ফসলগুলোতে মুনাফা তুলনামূলকভাবে বেশি। এক মণ মসুর ডাল উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় হয় ৩ হাজার ৬০০ টাকার মতো, যা বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার টাকায়। মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রতি মণে ব্যয় প্রায় ১ হাজার ৪০০ টাকা, আর কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ টাকায়। যদিও বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী দাম ওঠানামা করে।
কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কীটনাশক, সার, বীজ, জমির বর্গা, শ্রমিক খরচসহ অন্য বিষয়গুলো সরকারি খরচের হিসাবে আসে। তবে বিক্রির সময় পরিবহন, কৃষকের শ্রমের বিষয়টি ধরলে ধান চাষে কৃষকের লাভ একেবারেই সীমিত। ফলে তারা অন্য ফসলে ঝুঁকছেন, যেটি আমাদের খাদ্যনিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যেসব ফসলে অধিক লাভ হচ্ছে কৃষক সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন। ফলে ভুট্টার চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে আম ও অন্যান্য অঞ্চলে বিদেশী ফলের চাষ বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে ধান চাষ কমে আসবে এবং এতে এক ধরনের চাপ তৈরি হবে। এমনটি চললে ধান যেহেতু আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য, তাই ভবিষ্যতে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। সেজন্য কৃষককে ধান চাষে সম্পৃক্ত রাখতে উৎপাদন সহায়তা বাড়াতে হবে। তাদের মূল্য সহায়তা দিতে হবে, যাতে এটি অলাভজনক না হয়।’
বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, একরপ্রতি গম চাষে কৃষকের ব্যয় হয় ৪০ হাজার ৯৩০ টাকা। প্রতি একরে গড়ে ৩৮ মণ উৎপাদন ধরলে কেজিপ্রতি ব্যয় দাঁড়ায় ২৭ টাকা। বর্তমান বাজারদরে গম বিক্রি করে একরপ্রতি কৃষকের লাভ হচ্ছে প্রায় ১৯ হাজার ৮৭০ টাকা।
ভুট্টা চাষে লাভের পরিমাণ আরো বেশি। একরপ্রতি ফসলটি উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় ৫৭ হাজার ৪৭০ টাকা। প্রতি একরে গড়ে ১৩০ মণ উৎপাদন ধরলে প্রতি মণ উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ৪৪০ টাকা। বিপরীতে বাজারদরে বিক্রি করে একরপ্রতি কৃষকের মোট লাভ হচ্ছে ৫৯ হাজার ৫৩০ টাকার মতো।
সরকারি সংস্থাগুলো কৃষিজ পণ্যের উৎপাদন খরচ নির্ধারণে বেশ কয়েকটি বিষয় হিসাব করে। যেমন বীজ সংগ্রহ, বীজতলা তৈরি, রোপণ, সার ও কীটনাশক ব্যবহার, আগাছা দমন, জমি প্রস্তুত, সেচ, শ্রমিক মজুরি, জমির লিজ বা বর্গা এবং মাড়াই। তবে মাড়াই শেষে ধান পরিবহন, বাজারে নেয়া এবং অতিরিক্ত শ্রমিকের মজুরি যুক্ত করলে প্রকৃতপক্ষে কৃষকের হাতে কোনো লাভ থাকে না বলে জানিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বেনিপাড়া গ্রামের কৃষক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘চলতি আমন মৌসুমে গোদাগাড়ীর হাটে ধান বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। এত কম দামে ধান বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, সেচ ও শ্রমিকের খরচই ওঠানো কঠিন।’ তার মতে, ‘কৃষক বাঁচাতে হলে ধানের ন্যূনতম দাম অন্তত ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা জরুরি। নইলে কৃষকরা ধান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন।’
ধান চাষে লোকসান ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশে ভুট্টাসহ বিদেশী ফলের উৎপাদন ও চাষ দ্রুত বাড়ছে। তুলনামূলক বেশি লাভ এবং ক্রমবর্ধমান বাজার চাহিদার কারণে কৃষকরা ধান ছেড়ে এসব ফসলে ঝুঁকছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে কিনা—এটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। ন্যায্য দাম না পেলে কৃষক বিকল্প ফসল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকতেই পারেন। মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও রুচিতে পরিবর্তন আসছে, পাশাপাশি বাজারে নতুন নতুন পণ্যও যুক্ত হচ্ছে। এসব কারণে কৃষকের ফসল পরিবর্তন স্বাভাবিক। তবে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যদি তারা উৎপাদন থেকে সরে যায়, তাহলে সেটি উদ্বেগের বিষয়। তবে উৎপাদনশীলতা বাড়লে কৃষকের আয় বাড়বে এবং তখন তারা বিকল্প পেশা বা ফসলের দিকে ঝুঁকবেন না।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ভুট্টার উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ৫৯ হাজার টন। এক দশকের ব্যবধানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ লাখ ৮৪ হাজার টনে, যা দ্বিগুণেরও বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাব এখনো পাওয়া না গেলেও আগের অর্থবছরের মতোই উৎপাদন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লাভজনক ও সহজ চাষাবাদের কারণে মূলত ভুট্টা চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. মাহফুজ বাজ্জাজ। তিনি বলেন, ‘ভুট্টা চাষে কৃষকের খরচ তুলনামূলক কম, কিন্তু মুনাফা বেশি। এর চাহিদা ব্যাপক হওয়ায় বাজারজাত করতেও সমস্যা নেই। এছাড়া ভুট্টা গাছের প্রায় সব অংশই ব্যবহারযোগ্য—কাঁচা পাতা গবাদিপশুর খাদ্য, আর সংগ্রহের পর গাছ ও অবশিষ্টাংশ জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগে। তাই যেখানে লাভ বেশি, কৃষক স্বাভাবিকভাবেই সে ফসলের দিকেই ঝুঁকবেন।’
ভুট্টার পাশাপাশি দেশের মাটিতে উচ্চমূল্যের বিভিন্ন বিদেশী ফলের চাষও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ড্রাগন, মাল্টা, রাম্বুটান, স্ট্রবেরি, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, কাঠলিচু, সাম্মাম এবং মাচায় উৎপাদিত তরমুজ। এসব ফলের দেশীয় উৎপাদন বাড়ায় একদিকে কৃষি অর্থনীতিতে অবদান রাখছে, অন্যদিকে অনেক কৃষকের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থারও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদেশী ফলের মোট উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯২২ টন। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৭৭ টন হয়। এক বছরের ব্যবধানে উৎপাদন বেড়েছে ২১ হাজার টনেরও বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে সরিষার আবাদও। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে সরিষার উৎপাদন ছিল ৮ লাখ ২৪ হাজার টন। পরের অর্থবছর উৎপাদন বেড়ে ১১ লাখ ৬৩ হাজার টনে দাঁড়ায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক লাফে ১৬ লাখ টন ছাড়িয়ে যায় সরিষার উৎপাদন। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বৃষ্টির কারণে উৎপাদন কিছুটা কমে যায়। চলতি অর্থবছরে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ লাখ টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এসএম সোহরাব উদ্দিন সার্বিক বিষয়ে বলেন, ‘ধানে তুলনামূলক কম লাভ এটা ঠিক। তবে আমাদের কৃষিজমির বৃহৎ একটা অংশ আছে যেটি পানি ধারণ করে রাখে। সেসব জমিতে সব সময়ই ধান চাষ হয়। সেজন্য বড় আকারে ধান চাষে ধস আসবে না।’
ধান চাষে আলাদা করে কোনো ধরনের সহায়তা দেয়া হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের কৃষিজমি কমছে। সেজন্য আমরা উৎপাদনশীলতা বাড়ানোয় মনোযোগ দিয়েছি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাত নিয়ে আসতে কাজ করছে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারলে তখন জমি কমলেও খাদ্যনিরাপত্তায় প্রভাব পড়বে না।’