যুক্তরাষ্ট্রের মার্কিন প্রশাসন ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর করা পাল্টা শুল্কের প্রভাব এখন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মার্কিন বাজারে চীনা ও ভারতীয় পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশ এখন ক্রেতাদের নজরে এসেছে। এই পরিস্থিতি দেশের রফতানিমুখী পোশাক খাতকে নতুন সম্ভাবনার মুখে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশি তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ও রফতানিকারকরা বলছেন—মার্কিন বাজারে চীনা ও ভারতীয় পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের ফলে ক্রেতারা দ্রুত অর্ডার স্থানান্তর করছেন এবং এ সুযোগে বাংলাদেশকে নতুন বিনিয়োগ ও অর্ডারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করছেন। এই পরিস্থিতি শুধু রফতানিতে বৃদ্ধি আনছে না, বরং শিল্পে নতুন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাও তৈরি করছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী, চীন থেকে সরানো অর্ডার প্রবাহ আগামী মাসগুলোতে আরও বাড়তে পারে। ইউরোপীয় ক্রেতারাও বাংলাদেশে অর্ডার বাড়াতে আগ্রহী। সঠিক সহায়তা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি অর্জন করতে সক্ষম হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে টি-শার্ট রফতানিতে শীর্ষে বাংলাদেশ
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টি-শার্ট রফতানিতে শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও চীনের মতো প্রথিতযশা রফতানিকারক দেশগুলোকে পেছনে ফেলে এটি বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের (ইউএসআইটিসি) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র ১১৭টি দেশ থেকে মোট ৩৫২ কোটি ডলারের টি-শার্ট আমদানি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে এসেছে ৩৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের সমমূল্যের টি-শার্ট, যা নিকারাগুয়ার ৩৬ কোটি ১২ লাখ ডলারের রফতানি অতিক্রম করেছে।
বাংলাদেশ এর আগে কখনও যুক্তরাষ্ট্রের টি-শার্ট বাজারে শীর্ষস্থান অধিকার করতে পারেনি। ১৯৮৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩৬ বছর ধরে হন্ডুরাস, নিকারাগুয়া, হংকং, জ্যামাইকা, মেক্সিকো ও চীনের মতো দেশগুলো এই বাজারে আধিপত্য বজায় রেখেছিল। চীন ও হংকং ছাড়া বাকি দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তির কারণে শুল্ক সুবিধা পেয়ে আসছিল।
তবে ২০২৫ সালের শুরুতে এই চিত্র বদলে গেছে। ২ এপ্রিল থেকে ট্রাম্প প্রশাসন সব দেশের পণ্য আমদানিতে ন্যূনতম ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করলে—শুল্ক সুবিধা ভোগকারী নিকারাগুয়া ও হন্ডুরাসকেও যুক্তরাষ্ট্রে টি-শার্ট রফতানিতে অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হয়। এই নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যেই বাংলাদেশের টি-শার্ট যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষে পৌঁছেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুল্কের চাপে অন্য দেশগুলোতে রফতানি ব্যাহত হওয়ায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য এটি এক সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে কাজ করেছে।
মার্কিন পাল্টা শুল্ক ও বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩১ জুলাই বাংলাদেশি পণ্যে পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ নির্ধারণ করেন। অপরদিকে চীনের পণ্যে বাড়তি শুল্ক ৩০ শতাংশ এবং ভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ। তবে রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানির কারণে ভারতের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্কের কারণে ক্রেতারা বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছেন এবং বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে এই বিকল্প বাজার হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় একক বাজার যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বাজারে শীর্ষ ১০ রফতানিকারক দেশ হলো—ভিয়েতনাম, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়া। মার্কিন শুল্ক কাঠামোর পরিবর্তনের কারণে চীনের হারানো বাজার দখলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন— প্রথম ছয় মাসে চীনের পোশাক রফতানি কমেছে ১১০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করেছে। একই সময়ে ভিয়েতনামের রফতানি বেড়েছে ১১৯ কোটি ডলার এবং বাংলাদেশের বেড়েছে ৮৫ কোটি ডলার।
শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশের পণ্যের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। বাংলাদেশের মার্কেট শেয়ার এ বছরের জুনে ১০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা গত বছরের ৯.২৬ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এ ধরনের প্রবৃদ্ধি রফতানিমুখী খাতের জন্য এক নতুন সূচনা এবং দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের রফতানি প্রবৃদ্ধিকে শক্তিশালী করবে।
রফতানিতে বাড়তি ক্রয়াদেশ
বিগত দুই সপ্তাহে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি ক্রয়াদেশের চাপ লক্ষ করা গেছে। আগে স্থগিত হওয়া অর্ডারও ফেরত আসতে শুরু করেছে। মূলত দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোই সবচেয়ে বেশি নতুন অর্ডারের প্রস্তাব পাচ্ছে।
স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি শোভন ইসলাম জানান, “আগামী বসন্তের জন্য আমাদের কাছে ৫-১০ শতাংশ এবং গ্রীষ্মের জন্য ১০-১৫ শতাংশ বাড়তি ক্রয়াদেশ রয়েছে। ভারত ও চীন থেকে সরে আসা অর্ডার ধরে রাখতে আমরা ইতোমধ্যে অতিরিক্ত ওভারটাইমের অনুমতি নিয়েছি।”
শীর্ষ রফতানিকারক স্নোটেক্স গ্রুপের এমডি এস এম খালেদ বলেন, “এক মার্কিন ক্রেতা গত বছর ৭ লাইনে উৎপাদিত জ্যাকেটের কাজ এ বছর ১৭ লাইনে নিতে চাচ্ছেন। আরেক ক্রেতা ২০ লাইনের উৎপাদন ১০-১৫ লাইন বাড়াতে চাইছেন। বাড়তি অর্ডারের জন্য আমাদের প্রায় আড়াই লাখ ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। অনুকূল পরিস্থিতি থাকলে রফতানি ৩৫ কোটি ডলার ছাড়াবে।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রফতানি হয়েছে ৮৬৯ কোটি ডলার, যার প্রায় ১৮ শতাংশ আসে মার্কিন বাজার থেকে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকের অংশ ৭৫৪ কোটি ডলার। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে মার্কিন বাজার বাংলাদেশের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ রফতানি ক্ষেত্র।
চীনা বিনিয়োগের আগমন
চীনা বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। হান্ডা (বাংলাদেশ) গার্মেন্টস কোম্পানি চট্টগ্রামের মিরসরাই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ৪ কোটি ডলারের বিনিয়োগে পোশাক কারখানা স্থাপন করবে। একই অঞ্চলে খাইশি গ্রুপও ৪ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগে অন্তর্বাসসহ বিভিন্ন পোশাক উৎপাদনের কারখানা নির্মাণ করবে।
বেপজা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩৪টি চীনা বিনিয়োগকারী প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আটটি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। মোট প্রস্তাবিত বিনিয়োগ প্রায় ১৫ কোটি ডলার। এসব প্রতিষ্ঠান তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ব্যাগ, হালকা প্রকৌশল পণ্য উৎপাদন করবে।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “চীনা বিনিয়োগ ইতিবাচক। তারা শুধু বিনিয়োগ করবে না, ক্রেতাও নিয়ে আসবে। তবে অর্ডার বাড়াতে ব্যাংকিং সহায়তা, গ্যাস-বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ এবং কাস্টমস সহযোগিতা প্রয়োজন।”
কর্মসংস্থান ও নতুন শিল্প উদ্যোগ
রাজশাহীর বরেন্দ্র রাজশাহী টেক্সটাইল লিমিটেড দীর্ঘ ২২ বছর পর পুনরায় চালু হয়েছে। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উদ্যোগে চালু হওয়া এই মিল ছয় মাসের মধ্যে প্রায় দুই হাজার শ্রমিককে কর্মসংস্থান দিয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী—টেলি মার্কেটিং, তৈরি পোশাক ও অন্যান্য নতুন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে আরও ১০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য রয়েছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী বলেন, “কাজের জন্য ঢাকামুখী জনস্রোতের যুগ শেষের পথে। আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্প স্থাপন করে স্থানীয় মানুষের হাতে চাকরির অফার লেটার পৌঁছে দিতে চাই। রাজশাহীতে শ্রমঘন শিল্পে বিনিয়োগ তারই অংশ।” রাজশাহী মিল শতভাগ রফতানিমুখী হবে এবং নারী কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
চীনের হারানো ক্রয়াদেশে বাংলাদেশের লাভ
মার্কিন শুল্কের কারণে চীনের রফতানি প্রথমার্ধে ১৬ শতাংশ কমেছে। চীনের মার্কেট শেয়ার কমে এসেছে ১৮.৮৮ শতাংশে। অপরদিকে, ভিয়েতনাম একই সময়ে ৭৭৭ কোটি ডলার রফতানি করে বাজারের শীর্ষে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের মার্কেট শেয়ার বেড়ে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কিন শুল্কনীতির কারণে চীনের অর্ডার বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে।
চীনের রফতানি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনে কমেছে ১১০ কোটি ডলার। একই সময়ে ভিয়েতনামের রফতানি বেড়েছে ১১৯ কোটি ডলার এবং বাংলাদেশের বেড়েছে ৮৫ কোটি ডলার।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্কিন শুল্কনীতির কারণে চীনের অর্ডার স্থানান্তরিত হয়ে আসছে এবং বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তুসুকা গ্রুপের চেয়ারম্যান আরশাদ জামাল বলেন, “সেপ্টেম্বর থেকে আগামী গ্রীষ্মকালীন মৌসুমের ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করবে। তখন বোঝা যাবে বাড়তি কতো অর্ডার এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ব্যবহার করলে শুল্ক কিছুটা কমানো সম্ভব, যা আমাদের প্রতিযোগিতা আরও বাড়াবে।”
শিল্পে চ্যালেঞ্জ ও বিপদ
তবে সবুজ সংকেতের মাঝেও সংকট রয়েছে। দেশের মধ্য ও নিম্নমানের বহু কারখানা বন্ধের পথে। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট—বিশেষত গ্যাসনির্ভর ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ এ শিল্প খাতের বড় চ্যালেঞ্জ।
গত এক বছরে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে—সাভারে ২১৪, গাজীপুরে ৭২, চট্টগ্রামে ২১ ও নারায়ণগঞ্জে ২৬টি। এতে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। বিশেষত কার্যাদেশ কমে যাওয়া, ঋণখেলাপি, কাঁচামাল আমদানিতে এলসি জটিলতা, উচ্চ সুদহার, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি—সবই কারখানা বন্ধের মূল কারণ।
শিল্পে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিতাস গ্যাসের কাছে এক হাজার ১০০টিরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে, কিন্তু অধিকাংশই সংযোগ পায়নি। এর ফলে শিল্প খাত বিপর্যস্ত, নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না এবং উৎপাদন খরচ ৮-১০ শতাংশ বাড়ছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও নীতি প্রয়োজনীয়তা
তবে সব চ্যালেঞ্জের মাঝেও শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী। চীন থেকে সরানো অর্ডার, মার্কিন ক্রেতার বাড়তি চাহিদা, চীনা বিনিয়োগ এবং রফতানি বাড়ানোর জন্য সরকারিনীতি সমন্বয়— এগুলো একসঙ্গে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলছে।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন শুল্ক কাঠামো অপরিবর্তিত থাকলে, বাংলাদেশের রফতানি প্রবৃদ্ধি আরও গতিশীল হবে এবং দেশে নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ধারা তৈরি হবে। তবে সরকারের অবকাঠামো সহায়তা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, ব্যাংকিং ও কাস্টমস সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, রফতানি বৃদ্ধির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন উৎপাদন খরচ কমানো। এতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক দক্ষতা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং কাঁচামাল আমদানির সহজীকরণ অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন, ব্যাংকিং খাতে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, এলসি প্রক্রিয়ার দ্রুতায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রা ঝুঁকি হ্রাস করা হলে উৎপাদন খরচ আরও কমানো সম্ভব।
মার্কিন শুল্ক পরিস্থিতি প্রমাণ করছে যে বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সর্বদা পরিবর্তনশীল। চীনের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি হলে বিকল্প বাজার হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের জন্য যথেষ্ট নয়। স্থায়ীভাবে রফতানি বাড়াতে প্রয়োজন গুণগত মান বৃদ্ধি, ব্র্যান্ড তৈরি, বাজার সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতকরণ।
শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নতুন কারখানা, বিশেষত নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম এবং সাভারের শিল্প এলাকা পুনরায় সচল করতে সরকার প্রণোদনা দিচ্ছে। এছাড়াও বেপজা অঞ্চলে চীনা ও ভিয়েতনামি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং নতুন রফতানি বাজার তৈরিতে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে।
একই সময়ে, শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদন বাড়াতে ও ক্রয়াদেশ পূরণে শ্রমিকের দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান
বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। যদিও ভারত, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা রয়েছে। মার্কিন পাল্টা শুল্ক বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য সুযোগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে চীনের হারানো ক্রয়াদেশ, যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে স্থানান্তরিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ তা গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ কম, শ্রমিক দক্ষতা প্রায় আন্তর্জাতিক মানের এবং পরিবহন সুবিধা তুলনামূলকভাবে ভালো। এসব কারণে মার্কিন ক্রেতারা চীনের বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এই সুযোগ শুধু একটি অস্থায়ী বাজারের জন্য নয়। যদি বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ, সময়মতো ডেলিভারি এবং প্রযুক্তিগত উন্নতি বজায় রাখতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান স্থায়ী হবে।”
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
রফতানি খাতের বৃদ্ধির ফলে শ্রমবাজারে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। নারী কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে, বিশেষ করে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এছাড়া ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা নতুন চাহিদা পূরণে অংশ নিতে পারবে।
তবে সমন্বয়হীন নীতি, কারখানা বন্ধ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট এবং ঋণ খেলাপি সমস্যা সমাধান না হলে শিল্পে স্থায়ী প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে না। সরকারের উচিত দ্রুত শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, ব্যাংকিং সুবিধা ও নীতি সমন্বয় নিশ্চিত করা।
উল্লেখ্য, মার্কিন পাল্টা শুল্কের প্রভাব ইতিমধ্যে স্পষ্ট। চীনের হারানো ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে, মার্কিন ক্রেতারা বাড়তি অর্ডার দিচ্ছেন, চীনা বিনিয়োগকারীর আগমন হচ্ছে এবং রফতানি খাত শক্তিশালী হচ্ছে। তবে দেশের মধ্য ও নিম্নমানের কারখানা বন্ধ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, ঋণখেলাপি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি—এই চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান ছাড়া স্থায়ী উন্নতি অসম্ভব।
সংশ্লিষ্ট শিল্প বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সময় বাংলাদেশকে একটি স্থায়ী রফতানি হাব হিসেবে গড়ে তোলার। উৎপাদন খরচ কমানো, শ্রমিক দক্ষতা উন্নয়ন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, ব্যাংকিং সুবিধা ও নীতি সমন্বয়—এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত শুধুমাত্র মার্কিন বাজারে নয়, বিশ্বব্যাপী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প একদিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, অপরদিকে সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলছে। এখন সিদ্ধান্তমূলক সময়। সরকারি নীতি, বাণিজ্যিক উদ্যোগ, শ্রমিক ও বিনিয়োগকারীর সমন্বয়—এই তিনটি উপাদান যদি সঠিকভাবে মিলে যায়—তবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তৈরি পোশাক বাজারে এক শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারবে।