শিরোনাম
◈ ‘এই যুদ্ধ আমার না’— শান্তির বার্তা দিলেন ট্রাম্প ◈ রপ্তানির সোনালি সুযোগ, কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নয় ◈ বিদেশযাত্রায় ইমিগ্রেশনে ঝুঁকি এড়াতে ভ্রমণকারীদের কখনোই এই ৭টি কথা বলা যাবে না, বললেই বিপদ! ◈ লোহা কাটার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংক ডাকাতি, খুলনায় কৃষি ব্যাংকের ভল্ট চুরির রহস্য উদঘাটন ◈ চট্টগ্রামে চালের বাজারে অস্থিরতা কাটেনি, পাইকারিতে দাম কিছুটা কমলেও খুচরায় প্রভাব নেই ◈ এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা মাহিন সরকারকে বহিষ্কার ◈ জেট ফুয়েলের ২১০০ কোটি বকেয়া রেখে ইতিহাসের সর্বোচ্চ মুনাফা ঘোষণা বিমানের! ◈ হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প জেলেনস্কির বৈঠক শুরু ◈ মিয়ানমারে তীব্র সংঘর্ষ: নাফ নদীর পাড়ে কয়েকশ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা ◈ গাজা সংকটে আলোচনার নতুন সূচনা: হামাস যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মত

প্রকাশিত : ১৭ জুলাই, ২০২৫, ১১:৪৫ দুপুর
আপডেট : ১৯ আগস্ট, ২০২৫, ০২:০০ রাত

প্রতিবেদক : নিউজ ডেস্ক

মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা

অন্তরঙ্গ ভিডিও দেখিয়ে ব্ল‍্যাকমেইল করে টাকা নেন, চাঁদা না পেয়ে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সোহাগ

সময়ের আলো: পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) গেটে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যার ভিডিও ভাইরাল হলে তার নিথর দেহের ওপর পাথর নিক্ষেপ করে নৃশংসতা চালানোর দৃশ্য সবাইকে হতভম্ব করে। পাথর নিক্ষেপের পর মরদেহের ওপর লাফিয়ে উল্লাস করতে দেখা যায় খুনিদের। এ নির্মমতার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়ে সারা দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে-খুনিরা কেন এতটা নির্মম হয়ে উঠলেন? যদিও জানা যায়, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে পরিকল্পিতভাবে মিটফোর্ড গেটে নিয়ে হত্যা করা হয় সোহাগকে। এরপর মব নাটক সাজানোর চেষ্টা করা হয়। তবে পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে কিলিং মিশনের কেউ কেউ পুঞ্জিভূত ক্ষোভে হামলে পড়েছিলেন সোহাগের ওপর। যারা বিভিন্ন কারণে অতীতে সোহাগের নির্যাতন অথবা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছিলেন।

তাদেরই একজন মো. রিজওয়ান উদ্দিন অভি। ভিডিওতে পাথর নিক্ষেপের পরে উল্লাস করতে দেখা গিয়েছিল তাকে। পটুয়াখালী থেকে গ্রেফতারের পর অভিকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মো. রিজওয়ান উদ্দিন অভির বাবার নাম মনোরঞ্জন বসু ও মায়ের নাম বিউটি দেব মিলা। অভি জন্ম নেওয়ার কয়েক বছর পর মারা যান তার বাবা। এরপর পরিবারের অভাব ঘুচাতে অভিকে বাবার বাড়ি রেখে ২০০৭ সালে মালয়েশিয়া চলে যান তার মা বিউটি। সেখানে এক মুসলিম ব্যক্তিকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। ২০০৮ সালে অভিকে মালয়েশিয়া নিয়ে যান বিউটি। কিন্তু মায়ের ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি ভালো লাগত না অভির। তিনি ওবায়দুর রহমান নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে থাকা শুরু করেন। ওই ওবায়দুর রহমানের কাছে বিভিন্ন বিষয় জানার পর ইসলাম ধর্মের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয় তার। এর কয়েক বছর পর ফেসবুকে সুরভী নামে রাজবাড়ীর এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান অভি। প্রেমের টানে ২০১৭ সালে দেশে এসে ধর্মান্তরিত হয়ে সুরভীকে বিয়ে করেন। এরপর আড়াই লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটে একটি খাবারের দোকান দেন। ওই দোকান থেকে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় হতো। এরই মধ্যে স্ত্রীর পছন্দমতো কেরানীগঞ্জে পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করেন অভি। সেখান থেকে যা ভাড়া আসত আর দোকানের আয় দিয়ে ভালো মতোই চলে যেত তাদের সংসার।

এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার সোহাগ এক দিন অভির দোকানে গিয়ে প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিতে বলেন। কিন্তু অভি চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেন সোহাগ। এ ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর মোবাইল ফিরিয়ে দেন সোহাগ। কিন্তু অভি ও তার স্ত্রীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও রেখে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন সোহাগ। ধাপে ধাপে অভির কাছ থেকে ৯০ হাজার টাকাও নেন। এরপর থেকেই অভি আবার মালয়েশিয়া চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এক পর্যায়ে সোহাগের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ২০২৩ সালের শুরুতে মালয়েশিয়া চলে যান অভি। গত বছরের মে মাসে হুট করেই তার স্ত্রী সুরভীর আত্মহত্যার খবরে দেশে ফিরে আসেন।

স্ত্রীর সঙ্গে কখনো ঝগড়া না হওয়া এবং সংসারে অভাব না থাকায় কিছুতেই আত্মহত্যার ঘটনা মানতে পারছিল না অভি। স্ত্রীর মোবাইল ঘেঁটে আত্মহত্যার কারণ উদঘাটনের চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে লালবাগ এলাকার কেউ সুরভীকে বারবার কল দিত বলে নিশ্চিত হন তিনি। এরপর থেকেই সোহাগকে এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী হিসেবে ভাবতে থাকে অভি। আর অপেক্ষায় থাকে সোহাগকে শিক্ষা দেওয়ার। মিটফোর্ডে যেদিন সোহাগকে হত্যা করা হয় সেদিন লম্বা মনির ফোনে অভিকে জানান, আজ সোহাগকে ধরা হবে। এ খবর পাওয়ার পর অভি দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে দেখে সোহাগকে পেটানো হচ্ছে। এ সময় নিজের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে সে পাথর দিয়ে তাণ্ডব চালায়। যদিও বুধবার আদালতে রিমান্ড শুনানি চলাকালে আসামি অভি বলেছে, শুধু দূর থেকে একটি ছোট্ট পাথর নিক্ষেপ করেছি। আমি আঘাত করিনি।

গতকাল ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে ‘সোহাগ হত্যা মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে’ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এসএম মো. নজরুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজি না, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল। নিহত সোহাগ হাজী সেলিমের ভাতিজা পিল্লু কমিশনারের ছত্রছায়ায় অ্যালুমিনিয়ামের পল্লী বিদ্যুতের তারের ব্যবসা করতেন একসময়। পল্লী বিদ্যুতের যে তার চুরি হতো সেই তার কিনে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে বিক্রি করতেন। বিগত ১৭ বছর এই কাজ করেছেন নিহত সোহাগ। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সোহাগ তার ভোল পালটে বিএনপিতে আসেন। তাদেরই আরেকটি গ্রুপ তখন একই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে যান। তখন ব্যবসায়িক বিভেদ তৈরি হয় উভয়ের মধ্যে। সামনে নির্বাচনকে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য কোনো একটি মহল এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের মিশনে নামছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাছে এমন মনে হয়নি। ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব থেকেই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছে। নির্বাচন প্রভাবিত করা কিংবা সরকারকে বেকায়দায় ফেলানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড হয়নি।

এজাহার থেকে আসামি বাদ যাওয়ার বিতর্ক বিষয়ে একই সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এজাহার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হলো-মামলার জন্য নিহত সোহাগের সাবেক স্ত্রী লাকী আক্তার থানায় আসেন। কিছুক্ষণ পর সোহাগের সৎ ভাই রনিও থানায় আসেন। তারা নিজের মধ্যে পরামর্শ করে ২৩ জনকে আসামি করে একটি খসড়া এজাহার প্রস্তুত করেন। এর মধ্যে নিহতের আপন বড় বোন মঞ্জুয়ারা বেগম থানায় এসে এজাহার দায়েরের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তার সামনে আগের খসড়া এজাহার উপস্থাপন করা হয়। এ সময় তিনি আগের খসড়া এজাহার থেকে ৫ জনের নাম বাদ দিয়ে নতুন করে আরও একজনের নাম যুক্ত করে মোট ১৯ জনকে আসামি করে এজাহার দাখিল করেন।

তিনি বলেন, এজাহার একটি প্রাথমিক তথ্য বিবরণী মাত্র। এজাহারে উল্লেখিত ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষ প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করে। ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, ঘটনা চলাকালীন ৯৯৯ এর মাধ্যমে সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সরোয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায় অভিযুক্তরা একটা মবের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন। ‘চাঁদাবাজদের জায়গা নাই, ব্যবসায়ীদের ভয় নাই’ এমন সেøাগান দিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সরোয়ার ঘটনাস্থল থেকে সন্দেহজনক মাহমুদুল হাসান মহিন ও রবিন নামের দুজনকে গ্রেফতার করেন। পরবর্তীতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে আরও সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় মোট গ্রেফতারের সংখ্যা ৯ জন। ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, পাথর নিক্ষেপকারীদের মধ্যে অন্যতম অভিকে পটুয়াখালী থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এদিকে সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ৩ আসামির সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মহানগর হাকিম মো. সাইফুজ্জামান শুনানি শেষে রিমান্ডের আদেশ দেন। রিমান্ডে নেওয়া তিন আসামি হলো-নান্নু কাজী, রেজওয়ান উদ্দিন ওরফে অভিজিৎ বসু ও তারেক রহমান রবিন। আদালত সূত্র জানিয়েছে, শুনানির সময় বিচারক আসামিদের কাছে পরিচয় জানতে চান। তিন আসামি তাদের পরিচয় বলেন। এরপর বিচারক ঘটনার বিষয়ে আসামি মো. নান্নু কাজীকে জিজ্ঞেস করেন। তখন নান্নু কাজী বলেন, আমি প্রবাসী। তবে আমার মিটফোর্ডে ব্যবসা রয়েছে। অনেক আগে সোহাগের সঙ্গে ছোটখাটো ঝামেলা হয়েছিল। সেই কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। এরপর আসামি অভি বলেন, আমি ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে। শুধু দূর থেকে একটি ছোট্ট পাথর নিক্ষেপ করেছি। সোহাগকে তিনি আঘাত করেননি। পরে আসামি তারেক রহমান রবিন বলেন, আমি সোহাগকে কোনো আঘাত করিনি। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। এর বাইরে আমি কিছু জানি না।

উল্লেখ্য, গত ৯ জুলাই স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে সোহাগকে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে, ইটের জমাট বাঁধা খণ্ড দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে নৃত্য করেন কেউ কেউ। লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যার ঘটনায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় ১০ জুলাই মামলা হয়। নিহত সোহাগের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। যাদের ১০ জন এখনও অধরা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়