কল্যাণ বড়ুয়া, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর, কালিপুর, বৈলছড়ি, পৌরসভার জলদী, শিলকূপ, চাম্বল, পুকুরিয়া ও পুইছড়ি ইউনিয়নের একসময় অসংখ্য মৃৎশিল্পী কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পাইকাররা এসে ভিড় জমাতো এসব গ্রামে। বাসন-কোসন, সরা, সুরাই, হাঁড়ি-পাতিল, পেয়ালা, মটকা, ব্যাংক, থালা, বাটি, ফুলের টব, কলসি, পিঠার ছাঁচসহ নানা জিনিসের ছিল ব্যাপক চাহিদা।
তখন হাটবাজারে পরসা বসাতেন মৃৎশিল্পীরা, মাথায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে গ্রামের পথ বেয়ে ছুটতেন ব্যবসায়ীরা। অথচ সময়ের পরিবর্তনে এখন হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার এই পেশায় টিকে আছে, কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করছে।
উষার লড়াই
উষা রুদ্র (৪৩), সাধনপুর ইউনিয়নের রুদ্রপাড়ার বাসিন্দা ও মৃত মহিদ রুদ্রের স্ত্রী। ২০১১ সালে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুতে হতাশা ও চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যান তিনি। উপার্জনক্ষম কেউ না থাকায় পৈতৃক পেশা মৃৎশিল্পে মন দেন। আগে স্বামীর কাজে সহযোগিতা করলেও এখন একাই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
তিনি ধূপধানি, টাকবাতি (প্রদীপ), সরা, ছোট প্রদীপ, বরুনা, পেয়ালা, ভাপা পিঠার ছাঁচ, মনসাপূজার ঘটসহ নানা পণ্য তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু এই পেশায় কাঁচামাল সংগ্রহ, বৃষ্টিতে পণ্য শুকানো, এবং বাজারে কম চাহিদার কারণে আয়-ব্যয় মিলছে না।
মৃৎশিল্পের মূল উপাদান এটেল মাটি এখন সহজে মেলে না। পাহাড়ি বা গভীর জঙ্গল থেকে ৬০-৭০ ফুট গভীরে গিয়ে কষ্ট করে এই মাটি সংগ্রহ করতে হয়। ফলে খরচ বেড়েছে, আয় কমেছে। আগে বিনামূল্যে পাওয়া মাটি এখন কিনতে হয়। এছাড়া ঘাস, লাকড়ি, পন—সবকিছুর দাম বেড়েছে। হাতে বানানো পণ্য বিক্রি করতে প্রায় মাসখানেক সময় লাগে, তবুও যথাযথ দাম মেলে না।
বর্তমানে উষার হাতে প্রায় ৮ হাজার টাকার পণ্য মজুদ আছে, কিন্তু পাইকার না আসায় বিক্রি করতে পারছেন না। ছেলে গোবিন্দ রুদ্র সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, মেয়েকে সম্প্রতি দেনা করে বিয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি তিনি ইপসা (ইয়ং পাওয়ার সোশ্যাল অ্যাকশন) ও সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ পান এবং কিছু অনুদান পেয়ে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল কিনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঐতিহ্যের অবক্ষয়
চুকমী রুদ্র ও রিখা রুদ্র জানান, একসময় মৃৎশিল্পের ব্যাপক চাহিদা ছিল, প্রতিটি ঘরে ঘরে মাটির পণ্য ব্যবহার হতো। অসংখ্য কুমার পরিবারের জীবিকা ছিল এই শিল্পে। এখন চাহিদা নেই, বিক্রি নেই, ফলে হতাশা বাড়ছে।
১০৩ বছর বয়সী চারুবালা রুদ্র বলেন, “আগে মাটির বাসনে খাবার খেলে রোগ কম হতো, কলসীতে পানি রাখলে ফ্রিজের প্রয়োজন হতো না। এখন সিলভার ও মেলামাইনের কারণে মানুষের রোগবালাই বেড়েছে।”
সাধনপুরের ক্ষত্রেমাহন রুদ্র জানান, রুদ্রপাড়ায় প্রায় ৫০-৬০ পরিবার শুধু মৃৎশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এখন তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত।
প্রত্যাশা
মৃৎশিল্পীরা আশা করেন, সরকার বা উন্নয়ন সংস্থাগুলো সহযোগিতা করলে এই ঐতিহ্যবাহী পেশা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু আপাতত তারা সময় কাটাচ্ছেন অপেক্ষায়—হয়তো একদিন আবার ফিরে আসবে মাটির শিল্পের সেই গৌরবময় দিন।