মোঃ রফিকুল ইসলাম মিঠু, ঢাকা: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের তিন সপ্তাহ পার হলেও এলাকা এখনো ধ্বংসস্তূপে পরিণত রয়েছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসন এবং কার্যক্রম পুনরায় সচল করার উদ্যোগে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে বেবিচক (বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
একাধিক সূত্র জানায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন সংস্থা—বেবিচক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এবং কাস্টমস—কেউই নিজেদের দায়িত্ব স্বীকার করছে না। বরং একে অপরের দিকে দায় চাপাচ্ছে। এমনকি তাদের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনগুলোর তথ্যও একে অপরের সঙ্গে মিলছে না।
গত ১৮ অক্টোবর ২৭ ঘণ্টাব্যাপী ভয়াবহ আগুনে শত কোটি টাকার পণ্যদ্রব্য পুড়ে যায়। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমন ঘটনার পরও পদক্ষেপ নিতে দেরি হওয়ায় কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সি অ্যান্ড এফ নেতা বলেন, “আগুন লাগার পর প্রায় ৪৫ মিনিট কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছায় প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পরে। প্রাথমিকভাবে ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির কথা বলা হলেও প্রকৃত ক্ষতি আরও বেশি।”
অগ্নিকাণ্ডে বহু ব্যবসায়ীর স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়েছে। এক গার্মেন্টস উদ্যোক্তা জানান, “আমাদের কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ছিল, যা দেশে প্রথমবার আমদানি করা হয়েছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। এটা পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব।”
বেবিচক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস (বলাকা) এবং ঢাকা কাস্টমস—এই তিন সংস্থারই নিজস্ব নিরাপত্তা বিভাগ থাকলেও তাদের কার্যকারিতা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার কন্ট্রোল বিভাগের গাড়িগুলো অচল থাকায় আগুন নেভাতে দেরি হয়েছে, যা বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে। এ বিষয়ে ফায়ার কন্ট্রোল বিভাগের কর্মকর্তা খালেদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদনে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে সংস্থাগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। এক সংস্থা বলছে শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত, অন্য সংস্থা বলছে ধাতব পদার্থের অতিরিক্ত তাপ থেকেই আগুন লাগে। ধারণা করা হচ্ছে, স্কাই ক্যাপিটাল কোম্পানির দক্ষিণ পাশের এলাকা থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। বেবিচক জানিয়েছে, তাদের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন কয়েক দিনের মধ্যেই জমা দেওয়া হবে।
তিন সপ্তাহ কেটে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা এখনো পরিষ্কার করা হয়নি। পোড়া মালামাল, কালো দেয়াল আর গলিত পণ্য এখনো আগের মতোই পড়ে আছে। শ্রমিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম সাময়িকভাবে অন্য অংশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
বেবিচক দাবি করছে, ভবনের মালিকানা তাদের হলেও কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব ছিল বিমান ও কাস্টমসের হাতে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বলছে, ‘অমুক্ত পণ্য’ অপসারণের দায়িত্ব কাস্টমসের। অন্যদিকে কাস্টমসের দাবি, তাদের কাজ শুধুমাত্র শুল্ক আদায়—অগ্নিনিরাপত্তা বা পরিষ্কার কার্যক্রম বেবিচক ও বিমানের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
এই দায় এড়ানোর প্রবণতার কারণে এখনো কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি। খোলা আকাশের নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পণ্য পড়ে থাকায় ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তারা বলছেন, কার্গো ভিলেজের স্থবিরতা ইতিমধ্যেই রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রমে বড় ধাক্কা দিয়েছে। বিশেষ করে দ্রুত নষ্ট হওয়া পণ্য—ফলমূল, ওষুধ, এবং পোশাক শিল্পের স্যাম্পল—বিভিন্ন পর্যায়ে আটকে আছে।
ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এই বিলম্ব আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অভিজ্ঞ বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, “এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ২২ দিন পরও ধ্বংসস্তূপ না সরানো প্রশাসনিক অদক্ষতার বড় উদাহরণ। একে নিঃসন্দেহে ‘ফায়ার ম্যানেজমেন্ট ফেইলিউর’ বলা যায়।”