গত ১৭ মে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ঘুসের বিনিময়ে এক রোগীকে ভর্তি করান জুলাই অভ্যুত্থানে আহত আবু তাহের। ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি যাওয়ার মতো হলেও বিগত কয়েক মাস হাসপাতালটিতে অবস্থান করছেন তিনি। নিজে ঘুস নিয়ে এ ঘটনার দায় চাপান বহির্বিভাগের ২২১ নম্বর ওয়ার্ডে কর্মরত আবু রায়হান নামে এক কর্মচারীর ওপর। এ ঘটনায় অন্য আহতদের নিয়ে তিন দফায় রায়হানকে মারধর করেন হাসপাতালটিতে অবস্থান নেয়া জুলাইয়ে আহত ব্যক্তিরা। দিনে দুপুরে এক কর্মচারীকে দফায় দফায় প্রহার করার ঘটনায় হাসপাতালটিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। যদিও তদন্তে রায়হানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। বরং আহত আবু তাহেরের বিরুদ্ধেই ঘুস লেনদেনের সত্যতা পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে এ বিষয়ে জানতে আবু রায়হানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। সূত্র: বণিক বার্তা
গত ৯ মার্চ জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) ব্লাড ব্যাংকের একজন কর্মীকে মারধর করেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতরা। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন দুপুরের দিকে হাসপাতালটির অন্য কর্মীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা ও মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন তারা। একপর্যায়ে ব্যাপক সংঘর্ষ বেধে গেলে শিক্ষার্থী, আনসার, কর্মচারীসহ অন্তত ১৩ জন আহত হন। সংঘর্ষের পর হাসপাতালের কর্মীরা কর্মবিরতি পালন করেন। এতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ রোগীরা। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং নিটোরে এমন কাণ্ড নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। প্রায়ই জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের সঙ্গে হাসপাতাল দুটির চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংঘর্ষ, মারামারি, হাতাহাতি, কথাকাটাকাটির ঘটনা ঘটছে। তাদের থামাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে হাসপাতালগুলোর পরিবেশ। বিশৃঙ্খলার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ৫৫ জন রোগী রয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৪৫ জন ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অবস্থায় রয়েছেন। বাকি ৮-১০ জনকে হাসপাতালে থাকতে হবে। অন্যদিকে নিটোরে জুলাইয়ে আহত রয়েছেন ৭৫ জন। এর মধ্যে অন্তত ৫০ জন ছাড়পত্র পাওয়ার মতো। কিন্তু তারা হাসপাতালেই রয়ে গেছেন।
এর কারণ জানতে চাইলে নিটোরের পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে যারা ভর্তি আছেন, তাদের সবার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল। হাসপাতালে থাকা জরুরি নয়, এমন অনেকেও আছেন। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তারা হাসপাতালে ভর্তি না থাকলেও চলবে। বাড়ি গিয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা চালিয়ে নিতে পারবেন। যাদের নিয়মিত থেরাপি নেয়ার প্রয়োজন হয়, তারা নিকটস্থ হাসপাতাল থেকেও নিতে পারবেন। আমাদের এখানে এসে তারা শুধু নিয়মিত ফলোআপ করালেই চলবে। তার পরও আমরা জোরপূর্বক কাউকে রিলিজ দিই না। তবে কেউ যদি যেতে রাজি হয় তাহলে রিলিজ দেয়া হয়।’
অন্যদিকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেকে সুস্থ হওয়ার পরও সরকারের কাছে দাবিদাওয়া তুলে ধরা, পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং অনুদান প্রাপ্তির আশায় হাসপাতালে থেকে যেতে চান। তারা মনে করেন, আউট অব সাইট আউট অব মাইন্ড। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলে রাষ্ট্রের নজরের বাইরে চলে যাবেন। সহায়তা পাবেন না। রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা ক্যাটাগরি অনুযায়ী অনুদান পাচ্ছেন, সেগুলো হয়তো পাবেন না। সবসময় হাসপাতাল ভিত্তি করে সরকারি-বেসরকারি অনুদানগুলো আসে। হাসপাতালের বাইরে থাকা রোগীদের সরকারি সহায়তা পেতে সময় লাগে। এজন্য রোগীরা হাসপাতাল ছাড়তে চান না।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, এখনো অনেকের শরীরে গুলি রয়ে গেছে। ফলে টক্সিক ইফেক্টের কারণে মাঝে মাঝে চোখ লাল হয়, পানি পড়ে। এজন্য তিন-চার মাস পরপর এসে ফলোআপ করলেই চলবে। তারা মনে করেন, বাড়িতে গেলে তারা সেবা পাবেন না। তাই মাসের পর মাস হাসপাতালে থেকে যাচ্ছেন। আবার অনেকে আছেন পুরোপুরি সুস্থ, শুধু পুনর্বাসন দরকার। কিন্তু হাসপাতাল ছাড়লে পুনর্বাসনের অনিশ্চয়তার শঙ্কায় তারা হাসপাতাল ছাড়ছেন না। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘রিলিজ নেয়ার পর তারা যদি কখনো সমস্যায় পড়েন, তাহলে ট্রিটমেন্টের জন্য আসতে পারেন। তবে শুধু জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞানেই না, জেলা পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতে পারেন। সবসময় তারা বিষয়গুলো বুঝতে চান না।’
এদিকে প্রায় ১০ মাস ধরে হাসপাতালগুলোর প্রায় দেড়শ বেডে থাকছেন গণ-অভ্যুত্থানে আহতরা। ফলে সাধারণ রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। চক্ষুবিজ্ঞানের একজন ওয়ার্ড মাস্টার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখানে পুরুষ রোগীদের জন্য ৫৪টি আসন রয়েছে, যার সবই জুলাইয়ে আহতরা দখলে রেখেছেন। ফলে ১০ মাস ধরে সাধারণ কোনো রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না।’ তবে নিটোর ১ হাজার ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হওয়ায় অতিরিক্ত ৭৫ জন আহতকে আশ্রয় দিতে বেগ পেতে হচ্ছে না বলে জানান পরিচালক। যদিও হাসপাতালটিতে শয্যা না পেয়ে রোগীদের বারান্দায় অবস্থান করতে দেখা গেছে।
হাসপাতালটির একাধিক চিকিৎসক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অল্প বয়সে চোখ ও হাত-পায়ের মতো অঙ্গহানি হওয়ায় অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকে সাংসারিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এতে তাদের মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো নেই, যার প্রভাব পড়ছে হাসপাতালের সার্বিক শৃঙ্খলার ওপর। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসার পরিবেশ।
আহতদের মানসিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের দেখভালে চক্ষুবিজ্ঞানে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ছাত্র প্রতিনিধি নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বণিক বার্তাকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালে পড়ে থাকায় অনেক আহতের পরিবারে অশান্তি দেখা দিয়েছে। ফলে মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে চান তারা। আবার অনেকের চোখে এখনো গুলি রয়ে গেছে। উন্নত চিকিৎসা দরকার। অঙ্গহানি ঘটার কারণে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কী করে বাকি জীবন চলবেন জানা নেই। সব মিলিয়ে মানসিকভাবে সুস্থ নন তারা। তাদের পুনর্বাসনে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এরই মধ্যে গত শনিবার চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসারত চারজন বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুনর্বাসনের দুশ্চিন্তা ছাড়াও সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় দাবিদাওয়া তুলে ধরা ও সরকারি-বেসরকারি অনুদান পাওয়ার আশায় হাসপাতালেই অবস্থান করছেন তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিটোরে অবস্থান নেয়া আহত আইয়ুব আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা একটি বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছি। অনেকেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। ভবিষ্যতে কী করে জীবন চালাব জানি না। এজন্য সরকারি সহযোগিতা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চাই। ফলে আমাদের অনেকে এখানে থাকাকে নিরাপদ মনে করছেন। আমাদের এখানকার আহতরা প্রায় সবাই অচল। তারা পরিবারের জন্য এখন বোঝা। তাদের দীর্ঘমেয়াদি ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য আরো বেশি অর্থের প্রয়োজন। একজন অচল মানুষের সারা জীবনের খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়া প্রয়োজন। আমাদের কর্মসংস্থান ও সম্মানের সঙ্গে সমাজে বাঁচার জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়া উচিত। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া যেন দ্রুত হয় এটাই আমাদের চাওয়া।’
পুনর্বাসনে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কামাল আকবর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা সব আহতের তথ্য সংগ্রহ করেছি। তাদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। ক্যাটাগরি অনুযায়ী দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’