ভূঁইয়া আশিক রহমান: [২] গ্লোব বায়োটেকের হয়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনাকারী দলের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে বঙ্গভ্যাক্স কাজ করবে কিনা মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বোঝা যাবে। যদি দেখা যায় কাজ করছে না, তাহলে রি-ডিজাইন করে নেওয়া সম্ভব। গতকাল ডেল্টা, আজ ওমিক্রন, পরশু অন্য ভ্যারিয়েন্ট আসতে পারে। ফলে এরকম অবস্থায় নিজেদের সক্ষমতা তৈরি অত্যন্ত জরুরি। একসপ্তাহ আগে আমরা যেরকম রিলাক্স ছিলাম, এখন সেটা থাকতে পারছি না। সবসময় পরনির্ভরশীল নয়, স্বনির্ভরশীল হওয়া উচিত। নিজেদের ভ্যাকসিন নিজেরা তৈরি করতে পারলে অন্যদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। ‘বঙ্গভ্যাক্স’ বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় অর্জন। আমাদের টেকনোলজি আছে, বিজ্ঞানীরা দেশি, ওমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বঙ্গভ্যাক্সকে রি-ডিাজইন করা খুবই সম্ভব।
[৩] তিনি আরও বলেন, বঙ্গভ্যাক্স গত বছর ইঁদুরের ক্লিনিক্যাল স্টাডি করে মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি চেয়ে বিএমআরসিতে আবেদন করেছিলো। বিএমআরসি থেকে তখন আমাদের বলা হয়েছিলো মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করার আগে বানরের দেহে ট্রায়াল করতে হবে। ট্রায়াল করে প্রমাণ করতে হবে বঙ্গভ্যাক্স ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর। এর পরিপ্রেক্ষিতে বানরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করেছি। বানরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। যতোগুলো বানরের দেহে বঙ্গভ্যাক্স প্রয়োগ করা হয়েছিলো, সবগুলোর দেহেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এটা খুবই আনন্দের। ভালোলাগার।
[৪] বিএমআরসি থেকে যখন আমাদের বলা হলো, বানরের ট্রায়াল করে আমাদের ডাটা দাও, তখন বিশে^ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ চলছিলো। আমরা তখন বঙ্গভ্যাক্সকে রি-ডিজাইন করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর করা করে তৈরি করা হয়েছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের জিনোম সিকুয়েন্স সম্পর্কে তখন আমাদের অবগত হয়ে গিয়েছিলাম। যখন আমরা বানরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করি তখন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধী ভ্যাকসিনটিও বানরের ওপর প্রয়োগ করেছি। বানরগুলোকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে ইনফেক্টেড করেছি। এতে বানরের কোনো ইনফেকশন হয়নি। বরং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে। মাত্র একটি ডোজই ব্যবহার করা হয়েছিলো। সম্ভবত বঙ্গভ্যাক্স একডোজের ভ্যাকসিন হতে যাচ্ছে। যা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর। বানরের সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বিএমআরসিতে আমাদের রিভাইস ডকুমেন্ট জমা দিই। আমাদের ডাটা পর্যবেক্ষণ বা পুঙ্খানুপঙ্খভাবে দেখে বিএমআরসি খুব সম্প্রতি মানবদেহে ট্রায়ালের জন্য নৈতিক অনুমোদন দিয়েছে। আমরা এখন ওষুধ প্রশাসনের কাছে যাবো মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদনের জন্য। অনুমোদন পেলেই মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হবে।
[৫] ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন পেতে বিপুল পরিমাণ ডকুমেন্ট তৈরি করতে হয়। প্রায় হাজার পাতার মতো ডকুমেন্ট। ডকুমেন্ট তৈরির কাজ চলছে। আশা করছি আমারা আগামী সপ্তাহে এই ডকুমেন্ট জমা দিতে পারবো। প্রত্যাশা ওষুধ প্রশাসন খুব দ্রুতই মানবদেহে ট্রায়ালের অনুমোদন দেবে। যে প্ল্যান্টে বঙ্গভ্যাক্স ভ্যাকসিন তৈরি হবে, সেই প্ল্যান্ট ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করেছেন। ওষুধ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা বানরের ট্রায়াল চলাকালেও আমাদের আমন্ত্রণে টেকনিক্যাল কমিটির ডাটাগুলো বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করার টিকা উৎপাদনের অনুমোদনও দিয়েছেন।
[৬] ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন পেলে খুব শিগগিরই ৬০ জন সুস্থ মানুষের দেহে বঙ্গভ্যাক্সের টিকা প্রয়োগ করতে পারবো। এটা হবে ফেজ ওয়ান স্টাডিজ। ফেজ ওয়ান স্টাডিতে কার্যকর প্রমাণিত হলে ফেজ টু স্টাডি হবে। ফেজ টু স্টাডিতে যদি প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করে ফেজ থ্রি স্টাডি করবো। সফল হলে বঙ্গভ্যাক্স বাজারে আনার জন্য ওষুধ প্রশাসনের কাছে যাবো।
[৭] বঙ্গভ্যাক্স কবে বাজারে আসবে বলা মুশকিলÑ তবে সবকিছু ধারাবাহিকভাবে এগোলে, ট্রায়ালে আশানুরূপ ফলাফল পেলে, সবার সহযোগিতা যদি পাই, তাহলে আমরা আশাবাদী আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ তার নিজে উৎপাদিত ভ্যাকসিন ব্যবহার করে করোনা মোকাবেলায় নতুন পর্যায়ে উক্তীর্ণ হবে।
[৮] ফেজ ওয়ান ট্রায়ালে কেন কেবল ৬০ মানুষের দেহে বঙ্গভ্যাক্স প্রয়োগ করা হবে? কেন ৭০ বা তারও বেশি নয়? মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডিজাইন করার সময় আমরা ফাইজার ও মডার্নার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নমুনা দেখেছিলাম। তারা এরকম স্যাম্পল সাইজ নিয়ে কাজ করেছিলো। ফাইজার ও মডার্না বিবেচনায় নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে দুটিই এমআরএনএ ভ্যাকসিন। বঙ্গভ্যাক্সও এমআরএন ভ্যাকসিন। ফাইজার ও মডার্নার ভ্যাকসিনের চাহিদা বিশ^ব্যাপী বিপুল। তবে অন্য এমআরএনএ ভ্যাকসিনের চেয়ে বঙ্গভ্যাক্স একটু আলাদা। কারণ বঙ্গভ্যাক্স মাইনাস টুয়েন্টি ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে বেশ কয়েকমাস। এটা একডোজের ভ্যাকসিন।
[৯] ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কাজ করবে কি? বলা মুশকিল। ভ্যাকসিনটিকে ওমিক্রন প্রতিরোধী করে গড়ে তোলা কঠিন কাজ। তবে যদি আপনার কাছে টেকনোলজি থাকে, যখন ভ্যাকসিনটিকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে রিডাইজ করা গেছে, যখন ওমিক্রনের জিনোম সিকুয়েন্স জানা গেছে, বিশ^ব্যাপী প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ফাইজার, মডার্না ও জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিন ওমিক্রনের বিরুদ্ধে রিডিজাইন করছে। যেহেতু বাংলাদেশে টেকনোলজিটি আছে, বঙ্গভ্যাক্সের গবেষণা টিম পুরোটাই বাংলাদেশের, ফলে তাদের পক্ষে ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকর করতে বঙ্গভ্যাক্স রিডিজাইন অসম্ভব নয়। খুবই সম্ভব।