শামীম আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ আমাদের মাঝে নেই, তার প্রায় এক দশক হতে চললো। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান, অনন্য সব সৃষ্টি তাকে স্বাধীন বাংলাদেশের সফলতম সাহিত্যিকের আসনে বসিয়েছে। উপন্যাসের সাথে সাথে তিনি চমৎকার কবিতা লিখতেন, তার উপন্যাসে বেশ কয়েকজন প্রধান চরিত্র ছিলেন কবি; তাদের হাত দিয়ে অনবদ্য সব কবিতা বেরিয়েছে সেসব উপন্যাসে। এছাড়াও চলচ্চিত্র ও নাটক রচয়িতা এবং নির্মাতা হিসেবেও তিনি সামনের সারিতেই অবস্থান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা হুমায়ূন আহমেদের অবদান স্বাধীন বাংলাদেশে অপরিসীম।
কিন্তু আমি তার অন্য একটি দিক নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য, সিনেমা ও ব্যক্তিজীবনে সাহসের একটা অনন্য ভ‚মিকা আছে। আমি জানি সাহস বিষয়ে লিখতে গেলে প্রথমেই অসংখ্য মানুষ বলে উঠবেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি তো সম্মুখযুদ্ধ করেননি, পালিয়ে ছিলেন। তবে কীসের সাহস তার? আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ৭ কোটি মানুষের মধ্যে সাকুল্যে ১ লাখ মানুষ সম্মুখযুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তাই বলে দেশের বাকি ৬ কোটি ৯৯ লাখ মানুষ তো স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন না, ভীতু বা কাপুরুষও ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যারা অংশগ্রহণ করেছেন, তারা বীর, তারা নায়ক। তাদের সাথে অন্য কারও তুলনা হয় না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর সবচেয়ে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার মধ্যে দিয়ে। তারপর জাতীয় চার নেতা হত্যা, সেনাবাহিনীতে ক্যু, পাল্টা ক্যু, দীর্ঘ ১৫ বছর অবৈধ শাসকদের ক্ষমতা দখল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য অর্জনকে কলুষিত করেছিলো কিছুটা হলেও। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীকে কোনো মিডিয়ায় পাকিস্তান বাহিনী বলা হতো না, বলা হতো হানাদার বাহিনী। পাকিস্তানকে রক্ষার ও তাদের কুকর্ম ঢাকার এই বর্বরোচিত উদ্যোগ ছিলো সেনাশাসিত সরকারগুলোর। ওই কালো অধ্যায়ে হুমায়ূন আহমেদ তার সাহিত্য দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তার ক্ষুরধার বুদ্ধি ও মেধার পরিচয় রেখেছেন সূ²ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে অপদস্থ করে। হুমায়ূন আহমেদ তার জনপ্রিয় নাটক ‘বহুব্রীহি’তে পোষা পাখির কণ্ঠে ‘তুই রাজাকার’ বলিয়েছিলেন এমন এক সময় যখন টিভিতে ‘রাজাকার’, ‘হানাদার’ শব্দগুলো বলা নিষেধ ছিলো। তরুণ প্রজন্মকে রাজাকার ও পাকিস্তান হানাদার বাহিনী চেনানোয় হুমায়ূন আহমেদের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য।
এছাড়া ‘আগুনের পরশমনি’ চলচ্চিত্রে পাকিস্তানের জাতির জনকের ছবিতে থুতু দিয়ে তারপর সেই ছবির ফ্রেম মোছার মধ্যে প্রতীকীভাবে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনি তুলে ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীত তাকে আটক করে, নির্যাতন করে এমনকি গুলি করে মেরে ফেলার জন্য। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। শুধু পাকিস্তানি শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সাহসের ভ‚মিকা রেখেছেন অনেকবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার নিরাপদ চাকরি ছেড়ে দেন তিনি নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মানের জন্য। সারাদেশে তুমুল বিতর্কের মধ্যেও তিনি তার প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে পরবর্তী জীবনে যাকে ভালোবেসেছিলেন, তাকে বিয়ে করে, তার সাথে সংসার শুরু করেন। দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পরেও হুমায়ূন হাল ছেড়ে দেননি। তিনি বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। ওই সময়ে তিনি নান্দনিক সব ছবি আঁকেন, উপন্যাস লেখেন। তার সাক্ষাৎকারেও সাহসী ভ‚মিকা দেখতে পেয়েছি আমরা বারবার।
এটি লিখতে আমার ভালো লাগছে না, তবুও লিখতে হবে, জাতি হিসেবে বাংলাদেশিরা খুব যে সাহসী, তা নয়। মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রেই আমরা তুমুল সাহসের পরিচয় দিয়েছি, এমন ঘটনা বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক অঙ্গনে নির্ভীকতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়ালেও, সমাজে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সাহসিকতার পরিচয় দিতে ভয় পাই। নিজের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের চাইতে ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ আমাদের তাড়িত করে। হুমায়ূন আহমেদ সেই সমাজে ব্যতিক্রমী ছিলেন। সাহসী সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে কৃতজ্ঞতাচিত্তে স্মরণ করি। লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ