রউফুল আলম: প্রফেসর ব্যাকভাল ছিলেন ডিপার্টমেন্টের রিসার্চ হেড। এই লোকের খ্যাতি অনেক। তার নাম শুনলে দুনিয়ার বহু বাঘা বাঘা গবেষক নড়েচড়ে বসে। মেপে মেপে কথা বলে। প্রফেসর ব্যাকভাল ২০১০ সালে কেমেস্ট্রি নোবেল প্রাইজ কমিটির মেম্বার ছিলেন। তার ওজন বোঝাতে, এর বেশি পরিচয় সম্ভবত দেওয়ার দরকার নেই।
তিনি আমাদের একটা পিএইচডি কোর্স পড়াতেন। কোর্সের নাম ফিজিক্যাল অর্গানিক কেমেস্ট্রি। এই কোর্স করে শুধু পিএইচডি স্টুডেন্টরা। কোর্স পরীক্ষার আগে এক সপ্তাহ ধরে স্টুডেন্টদের নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য কাজ ফ্রোজেন হয়ে থাকে। এই কোর্স পরীক্ষার আগে প্রতিদিন তিনবার করে গোসল করতাম। দুই ঘণ্টা পড়ার পর মাথা দিয়ে ধোঁয়া উড়তো। মনে হতো চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথের ‘এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা’ জপলেও, কোনো শান্তি পেতাম না। বাথরুমে গিয়ে বিশ মিনিট ঝর্নার পানি ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। শরীর যখন ঠান্ডায় চাঁদপুরের ইলিশের মতো হিম হয়ে আসতো তখন বের হয়ে আবার পড়তে শুরু করতাম।
কোর্সের এক স্টুডেন্ট ছিলো ইতালিয়ান। তার নাম লুকা। এই ছেলেটার চেহারায় একটা রেনেসাঁ যুগের ছাপ। দাঁড়িগোঁফ একেবারে রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞানীদের মতো। তার ইংরেজি ছিলো খুবই দুর্বল। এ কারণে সে পারতপক্ষে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতো না। কিন্তু সে যখন নিজের ভাষায় কারও সঙ্গে কথা বলতো, মনে হতো করিডোরে কেউ বক্তৃতা দিচ্ছে। শব্দের প্রকম্পনে গ্লাসগুলো ফেটে পড়বে। কোর্স পরীক্ষার দিন লুকা পরীক্ষা দিতে আসলো না। স্টুডেন্ট হলো মাত্র আঠারো জন। সুতরাং কেউ না আসলে চোখে পড়ে। প্রফেসর ব্যাকভাল দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। কেন আসলো না সেটা নিয়ে ফিসফাস শুরু হলো। আমাদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। অস্থির হয়ে গেলেন। তাকে দেখে মনে হলো তিনি এখনই ফিট হয়ে পড়ে যাবেন। আর আমরা পরীক্ষা দেওয়া বাদ দিয়ে তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে থাকবো। হয়তো দেখা যাবে লুকা কোনো কারণ ছাড়াই পরীক্ষা দিতে আসেনি। কিন্তু সে দেশে ছাত্রের চেয়ে শিক্ষকের টেনশন বেশি। আহারে!
কোর্স পরীক্ষা হওয়ার পর একটা ই-মেইল পেলাম। সে ই-মেইলে একটা লিংক দেওয়া ছিলো। লিংকে গিয়ে কোর্স ও শিক্ষকের মূল্যায়ন করতে হবে। কোর্সের বিষয়বস্তু কেমন ছিলো, টিচার কেমন পড়িয়েছেন ইত্যাদি অনেকগুলো প্রশ্নের রেটিং করতে হয়। আগেও কোর্স শেষে এধরনের ইভ্যালুয়েশন করেছি। কিন্তু ব্যাকভালের ব্যাপারেও মূল্যায়ন করতে হবে এটা ভাবীনি। মনে করেছিলাম, এই লোক হলো রিসার্চ হেড, হয়তো তার মূল্যায়ন করতে হবে না। কিন্তু আমার ধারণা ছিলো ভুল। আমি বুঝলাম, যে জাতি মূল্যায়নের ব্যাপারে, জবাবদিহিতার ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেয় না, সে জাতি শত বছর সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে।