দীপক চৌধুরী: সুযোগসন্ধানীদের দল থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের দিকে সুনামগঞ্জের দিরাই আওয়ামী লীগ নেতা আছাব উদ্দিন সরদারের শোকসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দিচ্ছিলেন এম এ মান্নান। তখনই তাঁর সময়োপযোগী ও এই আলোচিত মন্তব্য। তিনি সুনামগঞ্জের মানুষ। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনের কথাগুলো উচ্চারণ করেন এই সাবেক আমলা ও বর্তমান রাজনীতিবিদ। আমরা জানি, সাধারণ মানুষের মনের ভেতরের স্বপ্ন ও ইচ্ছাকে বুঝবার ক্ষমতা যাদের নেই তারা কখনো জননেতা হতে পারেন না। কেবল প্রকৃত রাজনীবিদেরই এই গুণটি থাকে। উন্নয়নের জন্য দলীয় নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান এম এ মান্নান। সতর্ক করে দিয়ে তিনি এও বলেছেন, ‘তবে কিছু নেতা আছে, যারা ব্যবসা করার জন্য রাজনীতি করে। তারা সুযোগসন্ধানী, দুর্বৃত্ত। তাদের চিহ্নিত করে দল থেকে বের করে দিতে হবে।’ প্রকৃতপক্ষেই যে, এম এ মান্নান তৃণমূলের প্রাণের কথাগুলো বলেছেন, এটি বুঝলাম দিরাই এলাকায় নিজ বাড়িতে পা দিয়ে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তৃণমূলের মানুষের মনের কথা এটিই। অযোগ্যদের কর্তৃত্ব তারা ভীষণ অপছন্দ করেন।
২. জাতীয় প্রেসক্লাব হচ্ছে সাংবাদিকদের প্রাণকেন্দ্র। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকে প্রধান অতিথি করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে আসতে সম্মত হন। মনেপ্রাণে আপাদমস্তক একজন ভালো রাজনীতিবিদ তিনি। অকপটে সত্য বলে ফেলেন। এতে কে অখুশি হলো বা কারা ‘গেলো গেলো’ বলে চিৎকার করলো কিংবা কাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হলো এটা পরের বিষয়। সর্বত্র মোসাহেবের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তা সুখকর হবে না। এরমধ্যে আমরা হাতেগোনা কয়েকজন স্পষ্টবাদী ও সৎ নেতাকে পাই।
প্রেসক্লাবে ‘ঘৃণ্য আইন ইনডেমনিটি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, “সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার পদক্ষেপ বাঙালি জাতির মূল উদ্দেশ্যের পথে ‘কাঁটা’।” পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের বক্তব্য অর্থবহ ও স্পষ্ট। তিনি সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে ভালোবাসেন। বাঙালির জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সাম্প্রদায়িকতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। অথচ রাজনীতিতে জেনারেল জিয়া আর এরশাদ এটির বীজ রোপণ করে গেছেন। রাজনীতিবিদ এম এ মান্নানের মতো এটা এমন স্পষ্ট করে অনেকেই বলতে চান না। এর বহুবিধ কারণ আছে। তাদের জ্ঞানের পরিধি ও রাজনৈতিক সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাই না। তবে সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং বদল হচ্ছে। এটা আশার আলো।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বাঙালি জাতি আর পিছিয়ে থাকবে না। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। এখন তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। দেশের ১৮ কোটি মানুষের ঘরে বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে। গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ হচ্ছে। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল হচ্ছে। তাই দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সবাইকে শেখ হাসিনার পাশে থাকতে হবে। তাঁকে সাহস ও শক্তি জোগাতে হবে।’ দুজন সামরিক শাসক ও তাঁদের সঙ্গীসাথিরা অনেক মাইন পুঁতে রেখে গেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলার পথে এখনো অনেক মাইন পোঁতা আছে উল্লেখ করে আলোচনা সভায় দেওয়া বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘দায়মুক্তির পরম্পরা হিসেবে পরবর্তী পর্যায়ে দ্বিতীয় সামরিক শাসক (হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ) আরেকটি পেরেক মেরে রেখেছে। কীসের ওপরে? আমাদের জাতিসত্তার ওপরে।’
৩. বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের সময় প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার মরিয়া চেষ্টা দেখা যায় জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে। যদিও এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে বেশি জোরে জোরে কথা বলাবলি হচ্ছে। ইউপি ভোটে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নেই। কিন্তু এ দলটির প্রার্থী আছে স্বতন্ত্ররূপে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ দেখে মনে হচ্ছে, তারা পাস করছে সুকৌশলে। তাদের ‘মাঠছাড়া করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করে যারা বেড়াচ্ছেন আসলে ওরা সুবিধাবাদী ও মিথ্যুক। তৃণমূলের বাস্তবতার ব্যাপারে শোনা যাচ্ছে, সুবিধাবাদী কতিপয় আদর্শবিরোধী তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতার খুঁটির জোর পাচ্ছে তৃণমূলের বিএনপিওয়ালারা। বিএনপির প্রার্থীকে যেকোনো উপায়ে পাস করানোর জন্য আওয়ামী লীগের একাংশ কৌশলে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষেই গোপনে কাজ করছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধ হচ্ছে। অথচ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে উভয়েরই যেহেতু খুঁটির জোর আছে, তাই কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এর ফলাফল তৃণমূল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সুতরাং সতর্কতা জরুরি। হোক না স্থানীয় সরকার নির্বাচন। নৌকাপ্রার্থী দেওয়ার নামে তৃণমূলে কোথায় কোথায় কী কী জঘন্য কাজ হচ্ছে এই খবর আজ বলবো না।
৪. বিএনপি-জাতীয় পার্টির নেতারা কী ভুলে গেছেন কী রকম ভয়ংকর অবস্থা ছিল দেশে- যেখানে ধানক্ষেতে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লাশ পাওয়া যেতো? নদীর জল লাল হয়ে যেতো রক্তে। কী না হতো এরশাদের ইউপি নির্বাচনকালে? নির্বাচন নিয়ে জিয়া-এরশাদের নিষ্ঠুরতা ভুলবার নয়। তখন তো স্থানীয় ও জাতীয় সরকারের নির্বাচন হতো এরশাদের ইচ্ছায়। মনে পড়ছে হাজার কাহিনীর মধ্যে একটি কাহিনী। সেটা ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ। তারিখ ১৩ ফেব্রুয়ারী। এদিনও বিরোধী জোটগুলোর ডাকে পূর্বঘোষিত সকাল-সন্ধ্যা কর্মসূচি অতিবাহিত হচ্ছিল। এর কিছুদিন আগে (অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮) ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে। এর মূল্যায়ন ও বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়েছি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাসায়। তিনি থাকতেন হেয়াররোডে। হেঁটে হেঁটে গেলাম হেয়ার রোডে। সময় ছিল পূর্ব নির্ধারিত। রাজনীতির নানাকথা, নানাকৌশল, এরশাদের গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনাকালে প্রবীণ রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেছিলেন, ‘একটি কথা চিরন্তন যে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে লাঠি ঘোরানো যায়, গুলি চালান যায় কিন্তু রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। তবে এটা অব দ্য রেকর্ড বললাম, লিখবা না।’ সেই সময় ইউপি নির্বাচনে কয়েকহাজার আহত-নিহতের ঘটনা ঘটে। নির্বাচনি সন্ত্রাসে প্রাণহানি ঘটেছিল দু’শ লোকের। ( সূত্রগ্রন্থ : স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই, বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা : দীপক চৌধুরী)। দীর্ঘ নয় বছরের এই স্বৈরশাসনের যুপকাষ্ঠে কতো বীর সন্তান শহীদ হয়েছে এর হিসেব পাওয়া মুশকিল। লাশ লুকিয়ে ফেলার, লাশ গুম করার বহু ঘটনা ঘটেছে এরশাদ আমলে। ষড়যন্ত্র করা-ই ছিল বুলেটপ্রিয় স্বৈরাচার সরকারের যেনো স্বাভাবিক আচরণ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও পরবর্তীকালে সামরিক শাসনের মাধ্যমে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষছাড়া কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই খুনিদের ও ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী জালিমদের বিচার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং আজকের বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুদৃঢ় ও সমৃদ্ধ করতেই স্পষ্টবাদী রাজনীতিক খুবই জরুরি। সুস্পষ্ট কথা বলার মতো যোগ্য মন্ত্রী দরকার। তৃণমূলের রাজনীতিতে নজরদারি কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। এম এ মান্নান তাঁদের মধ্যে একজন।
লেখক : উপসম্পাদক, আমাদের অর্থনীতি, সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক