আমিনুল ইসলাম
ঘটনা এক: একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষক ভুয়া পিএইচডি নিয়ে বছরের পর বছর শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। ঢাকার প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির এই ছয় শিক্ষকের অধীনে অনেকে মাস্টার্স থিসিসও করেছে। এর মধ্যে একজন বাংলাদেশ সরকারের বড় কর্তাও ছিলেন। তাদের মাঝে কেউ অধ্যাপক হয়েছেন। কেউ সহযোগী অধ্যাপক। একজনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন? তিনি আমেরিকার এমন এক ইউনিভার্সিটির নাম বলেছেন, যার কোনো অস্তিত্ব নেই।
ঘটনা দুই: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এবার যে ছেলেটা ফার্স্ট হয়েছে, সে গিয়েছিলো তার কোচিং সেন্টারে, যেখানে সে কোচিং করেছে। তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছিলো। এমন সময় আরেক কোচিং সেন্টারের মানুষজন এসে তাকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে। এই কথা আবার ওই ছেলে নিজেই জানিয়েছে। কেন ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে? কারণ তাকে দেখিয়ে কিছু ব্যবসা করা যাবে।
ঘটনা তিন: সপ্তাহ তিনেক আগে আমি দেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘাঁটছিলাম। তার মাঝে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সহযোগী অধ্যাপকের কোনো পিএইচডি নেই। তবে তিনি বোধকরি এই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে সব মিলিয়ে কেবল একজন শিক্ষকের পিএইচডি আছে। বাদবাকি কারও পিএইচডি নেই। এই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানেরও কোনো পিএইচডি নেই। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই আমার বড় কিংবা ছোট ভাইবোন। তাদের অনেককেই আমি চিনি, জানি। তাদের প্রতি সকল রকম শ্রদ্ধা, ভালোবাসা কিংবা স্নেহ আমার আছে। আমার এই লেখা কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ব্যক্তি বিশেষের ওপর নয়। পুরো বিষয়টা তুলে ধরার জন্যই এই উদাহরণগুলো দেওয়া।
তো আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ভদ্রমহিলাকে সপ্তাহ দুয়েক আগে ই-মেইল করে লিখেছিলাম, আমার ইচ্ছা আছে পরেরবার যখনই দেশে যাই, আপনার বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের গবেষণা পদ্ধতি বিষয়ে একটা/দুটো গেস্ট লেকচার দেওয়ার। এসব দেশে ছাত্রদের পড়িয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, সেটা দেশের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। এতে করে আপনার ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে। এই ই-মেইলে আমি আরও লিখেছি, আমাকে এর জন্য কোনো টাকা দিতে হবে না। আমি স্রেফ আমার নিজের আগ্রহের জায়গা থেকেই করবো। আমাকে কোনো রকম সার্টিফিকেট কিংবা কিছুই দিতে হবে না। এর কোনো কিছুর আমার প্রয়োজন নেই। ছাত্রছাত্রীরা যদি আমার সঙ্গে দুয়েকটা ক্লাস করে গবেষণা করার বেসিক বিষয়টা জানতে পারে, তাতেই আমি খুশি হবো। আমি এই ই-মেইলের কোনো উত্তর পাইনি। শেষমেশ আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ফোন করেছি। ভিসি স্যার আমাকে বলেছেন, তারা মনে হয় পরীক্ষার কাজে ব্যস্ত। এ জন্য উত্তর দিতে পারেনি। কেউ কি আমাকে বলবেন, যেই ভদ্রমহিলা একই সঙ্গে সহযোগী অধ্যাপক, অর্থাৎ তিনি ছাত্রছাত্রী পড়ান, আবার বিভাগীয় প্রধানও তিনি। অর্থাৎ অন্য কাজও তাকে করতে হয়। সেই সঙ্গে তিনি নাকি আবার পিএইচডিও করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এতো কিছু করার সময় তিনি কোথায় পাচ্ছেন? নিজের জন্য এই মহিলার সময়ের অভাব হচ্ছে না। কিন্তু তার ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হবে, এই বিষয়ে একটা মেইলের উত্তর পর্যন্ত তিনি দিতে পারছেন না। পুরো সমাজবিজ্ঞান বিভাগে (অন্য সকল বিভাগেও একই চিত্র) অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের ছড়াছড়ি। অথচ পিএইচডি করা শিক্ষক গুনে গুনে দুয়েকজন আছেন। তাও বেশিরভাগই পিএইচডি করেছেন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিংবা চট্টগ্রাম, রাজশাহী অথবা ভারত থেকে। যে কেউ, যেকোনো জায়গা থেকে পিএইচডি করতে পারেন। আমার এতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পিএইচডি করেন, তারা কি আদৌ গবেষণা কী জিনিস, সেটা জানে কিংবা বোঝেন?
ঘটনা চার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অধ্যাপকের পিএইচডি থিসিসের ৯৫ ভাগই নকল। অর্থাৎ অন্য কোথাও থেকে কপি করা। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির দুইজন শিক্ষককে ক’দিন আগেই কপি-পেস্ট করার অপরাধে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই অবস্থা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পিএইচডি করছেন, তাদের অবস্থা আসলে কেমন? এখানে তো কেউ পুলিশের চিফ থাকা অবস্থায় পিএইচডি করে ফেলছেন। কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান থাকা অবস্থায় পিএইচডি করে ফেলেছেন। তাদের মতো মেধাবী পুরো পৃথিবীতেই খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। আর ইউরোপ-আমেরিকায় ছাত্রছাত্রীরা বছরের পর বছর ফুল টাইম সময় দিয়েও পিএইচডি শেষ করতে পারছেন না। বাংলাদেশে শিক্ষকদের গিয়ে যদি জিজ্ঞেস করেন বেসিক গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে, আমার ধারণা তারা বলতেও পারবেন না। তাদের অনেকে হয়তো জানেনও না পৃথিবীরর সকল বিষয়ে (সেটা হতে পারে পদার্থবিদ্যা, ব্যবসা কিংবা সমাজ বিজ্ঞান) অর্থাৎ সকল সাবজেক্টে বেসিক গবেষণা পদ্ধতি এক। হয়তো ডাটা কালেকশন মেথড কিংবা এনালাইসিসের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু গবেষণার ধাপগুলো সব একই। অর্থাৎ আপনি যদি সমাজবিজ্ঞান বিভাগে বেসিক গবেষণা পদ্ধতি পড়াতে পারেন, আপনি ব্যবসার ছাত্রদেরও সেটা পড়াতে পারবেন। এরপর অন্য বিষয়গুলো তারা আলাদা করে শিখতে পারবেন। আমার এই লেখাটা শুরু করেছিলাম ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ভুয়া পিএইচডিধারী শিক্ষক নিয়ে। আমার ধারণা, বাংলাদেশে ভুয়া পিএইচডিধারী শিক্ষক এবং সত্যি সত্যই পিএইচডিধারী শিক্ষকের মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। কারণ যারা পিএইচডি ডিগ্রি নেন, তারা সেটা স্রেফ নিজেদের জন্য নেন। নামের পাশে ডক্টরেট ডিগ্রি থাকবে, নিজেরা প্রমোশন পেয়ে অধ্যাপক হবেন কিংবা অন্যান্য পদপদবির জন্যই তাঁরা পিএচিডি ডিগ্রি নেন। তাদের বেশিরভাগই (সবাই নন) সঠিক শিক্ষার জন্য কিংবা গবেষণার জন্য এই ডিগ্রি নেন না। কেউ ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর জন্য ডিগ্রি নেন না। ছাত্রছাত্রীদের কথা তাঁরা চিন্তাও করেন না। তাঁদের উদ্দেশ্য স্রেফ পদ এবং পদবি। Aminul Islam-র ফেসবুক ওয়ালে লেখাটি পড়ুন।